কাজী শামসুল হক

প্রকাশিত: ০৫ জুন ২০২৫ , ১০:৫০ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

হজ্জ কুরবানী : আনুষ্ঠানিকতা ও সম্পৃক্ততা

হজ্জ কেবল একটি নির্দিষ্ট মাসে নির্দিষ্ট স্থানে সম্পাদিত কিছু আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি এমন এক আধ্যাত্মিক সাধনার নাম, যেখানে মানুষ তার অন্তর, শরীর ও চিন্তাকে আল্লাহর পথে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে। এই হজ্জের অঙ্গ হিসেবে কুরবানী—যা শরিয়তের পরিভাষায় হাদী- তা যেন এক প্রতীকী আত্মত্যাগ, যার শিকড় বহু যুগ আগে ইব্রাহিম (আ.)-এর ছুরিতে প্রবাহিত রক্তের ধারায় নিহিত। মিনায় এই হাদী কুরবানী শুধু পশু জবাই নয়, বরং এক মৌন উচ্চারণ—“হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমি আমার সর্বপ্রিয়কে উৎসর্গ করছি।”আল্লাহ তাআলা বলেন:

﴿لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَـٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ﴾

“তাদের মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ, ২২):

এই আয়াতটি হজ্জ কুরবানীর অন্তর্নিহিত অর্থকে নির্যাসরূপে উপস্থাপন করে- যে কুরবানীতে অন্তরের ইখলাস না থাকে, তা খোলসমাত্র; আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না বাহ্যিক রক্ত বা গোশত, বরং পৌঁছায় অন্তরের একান্ত সত্তা।

এই কুরবানীর আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যখন ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে নিজের প্রাণাধিক পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কুরবানীর জন্য প্রস্তুত করেন, এবং ইসমাঈল (আ.) বিনা দ্বিধায় সায় দেন। আল্লাহ বলেন:

﴿فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ﴾

“অবশেষে যখন তারা উভয়ে আল্লাহর আদেশে আত্মসমর্পণ করল এবং তিনি (ইব্রাহিম) পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন।”

(সূরা ছাফফাত, ৩৭:১০)

﴿وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ﴾

“আর আমি তার পরিবর্তে একটি মহান কুরবানী দিলাম।” (৩৭:১০৭)

এই কুরআনিক বিবরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, হজ্জের কুরবানী মানে শুধু পশু জবাই নয়- বরং আল্লাহর জন্য নিজের প্রিয় বস্তু ত্যাগের প্রস্তুতি।

ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী, তামাত্তু ও কিরান হজ্জ পালনকারীদের জন্য এই হাদী কুরবানী ওয়াজিব। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন- যদি হাজী কুরবানী না দিতে পারে, তবে তাকে তিন দিন হজের সময় এবং সাত দিন ফিরে এসে রোযা রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন:

﴿فَمَن تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ ۖ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ﴾ (সূরা বাকারা, ২:১৯৬)

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, কুরবানী না দিতে পারলে উপবাসের নির্দেশ রয়েছে—যা শরীর ও আত্মার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের একটি বিকল্প পথ নির্দেশ করে।

তবে বাস্তবতা হলো, কুরবানীর এই অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে হাজীদের মনোভাবে। আজকের সমাজে, বিশেষ করে ধনী মুসলমানদের মাঝে, কুরবানী অনেক সময় এক প্রতিযোগিতামূলক আত্মপ্রদর্শনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে—কে বড় গরু আনছে, কার উট বেশি দামি, কার ছবি বেশি ভাইরাল। অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন—ইখলাস, বিনয় ও ত্যাগই হচ্ছে ইবাদতের প্রকৃত আত্মা।

মহানবী (সা.) নিজ হাতে কুরবানী দিয়েছেন, এবং দোয়া করেছেন:

اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ

“হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবার এবং মুহাম্মদের উম্মতের পক্ষ থেকে এই কুরবানী কবুল করুন।” (তিরমিজি, হাদীস ১৫২১)

এতে প্রতিফলিত হয় এক বিশাল হৃদয়ের দোয়া—যেখানে নিজের পরিবারই নয়, সমগ্র উম্মতের জন্য কবুলিয়তের প্রার্থনা আছে। সুতরাং কুরবানী হতে হবে উদারতা, সহমর্মিতা ও ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ।

হজ্জ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির আগমন কুরবানী ব্যবস্থাপনাকেও পাল্টে দিয়েছে। সৌদি আরব সরকারের পরিচালিত Adahi Project বা “মাকতাব আল-হাদী” কার্যক্রমের মাধ্যমে এখন হাজীরা সরাসরি কুরবানীর জন্য নির্ধারিত হালাল পশু বুকিং দিতে পারেন। এই ব্যবস্থায় পশু নির্বাচন, জবাই, মাংস বিতরণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো সকলই অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিতভাবে সম্পন্ন হয়।

এই আধুনিক ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভাউচার, মোবাইল অ্যাপ, এবং ডিজিটাল কনফার্মেশন এসএমএস-এর মাধ্যমে হাজী নিশ্চিত হতে পারেন যে তাঁর হাদী কুরবানী সম্পন্ন হয়েছে। সময় ও ভিড়ের কারণে নিজ হাতে কুরবানী করতে না পারলেও, নিয়তের পরিশুদ্ধতা থাকলে প্রযুক্তি এই ইবাদতের পূর্ণতা নষ্ট করে না। বরং ইসলামি আইনবিদরা (মুফতিগণ) একমত যে, প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে কুরবানী করা শরিয়তসম্মত এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে এই প্রতিনিধি নিয়োগ এখন আরও সহজতর হয়েছে।

তবে এখানেই প্রশ্ন: কুরবানীর বাহ্যিক কাজটি যখন ডিজিটাল মাধ্যমে হয়ে যায়, তখন কি অন্তরের তাকওয়ার চর্চা বিস্মৃত হয়? প্রযুক্তি আমাদের সেবা দিতে পারে, কিন্তু আত্মিক প্রস্তুতির দায়িত্ব আমাদেরই। হাজী যদি মনে করেন—‘আমি টাকা পাঠালাম, কাজ শেষ’—তাহলে সেখানে কুরআনের সেই আহ্বান অনুপস্থিত থাকে: ﴿وَلَـٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ﴾।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা হলো কুরবানীর মাংস ব্যবস্থাপনা। আধুনিক সৌদি প্রশাসন পশুর মাংস সংরক্ষণ করে “ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (IDB)”-এর মাধ্যমে বিশ্বের দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে তা বিতরণ করে থাকে। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র জনগণ, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাতেও এই কুরবানীর মাংস পৌঁছে যায়। এখানে কুরবানী এক বৈশ্বিক উম্মাহর মেলবন্ধনে পরিণত হয়।

এই বিশাল কার্যক্রম দেখলে বোঝা যায়—হজ্জ কুরবানী কেবল ব্যক্তি ইবাদত নয়, বরং তা সামষ্টিক কল্যাণের ধারক। আজকের দুনিয়ায়, যেখানে মানুষ মানুষকে ভুলে গেছে, সেখানে এই কুরবানী যেন আল্লাহর পথে ত্যাগের এক প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়—যার আলো সমাজের অন্ধকার গলিতে পৌঁছায়।

এইভাবে, হজ্জের কুরবানী শুধুমাত্র ছুরি চালিয়ে পশু জবাই নয়, বরং তা আত্মার পশু—অহংকার, কৃপণতা, কামনা, আত্মগর্ব—এসবের জবাইয়ের চর্চা। হজ্জ শেষ হয় কিন্তু তার শিক্ষার কোনো শেষ নেই। হাজী ফিরে যান কিন্তু তাঁর অন্তরের মিনায় প্রতিদিন যেন কুরবানী চলতে থাকে—প্রতিদিনের সেজদায়, প্রতিদিনের দানে, প্রতিদিনের ক্ষমা প্রার্থনায়।

উপসংহার এই যে, হজ্জের কুরবানী কোনো রূপগত আনুষ্ঠানিকতা নয়। এটি হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য অন্তরের একটি শুদ্ধতম প্রতিশ্রুতি। আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্তিতে এই ইবাদতের রূপ হয়তো পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু মূল চেতনা যেন অটুট থাকে। ইব্রাহিম (আ.) যখন ছুরির ফলায় সন্তানের কণ্ঠ চাপা দিয়েছিলেন, তখন পৃথিবীতে যে ত্যাগের ইতিহাস লেখা হয়েছিল, তা আজো মিনার প্রতিটি কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়- “লাব্বায়্‌ক! আল্লাহুম্মা লাব্বায়্‌ক!”