এখন সময় ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বার ২০২৪ , ০৬:১৯ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

ভারতে প্রাচীন মসজিদে ‘সার্ভে’ চালানো নিয়ে ব্যাপক সহিংসতা : নিহত ৩

ভারতে উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে মুঘল যুগের একটি প্রাচীন মসজিদে ‘সার্ভে’ বা সমীক্ষা করানোর নির্দেশকে ঘিরে স্থানীয় জনতা ও পুলিশের মধ্যে রোববার দফায় দফায় বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন।

ঘটনার পর এলাকায় তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।

শহরের যে মসজিদটিকে ঘিরে এই বিরোধ, সেটি ‘শাহী জামা মসজিদ’ নামে পরিচিত।

হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর দাবি, প্রাচীন একটি হিন্দু মন্দির ভেঙেই এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল, ওই ভবনের স্থাপত্যে এখনো যার প্রমাণ রয়েছে।

এই দাবিকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসিলম গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আদালতে আইনি লড়াইও চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি আদালত ওই মসজিদ প্রাঙ্গণে সার্ভে করানোর নির্দেশ দেয়ার পর থেকেই নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়।

ওই মসজিদ ভবনটিতে আগে কোনো হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল কি না, সেটা যাচাই করে দেখার জন্যই ওই সার্ভের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

সম্ভালের পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, রোববার (২৪ নভেম্বর) সকালে প্রশাসনের একজন ‘অ্যাডভোকেট কমিশনারের’ নেতৃত্বে একটি সার্ভে টিম মসজিদে তাদের কাজ শুরু করতেই বাইরে অনেক জনতা জড়ো হয়ে যায় এবং অনেকটা সাথে সাথেই সহিংসতা শুরু হয়ে যায়।

পুলিশ বলছে, প্রায় এক হাজার মানুষ তখন মসজিদের বাইরে ছিল – যারা তাদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দিতে থাকে।

যেভাবে সহিংসতা ছড়াল

ঘটনাস্থলে মোতায়েন পুলিশ কর্মীদের লক্ষ্য করে পাথর ও ইটপাটকেল ছোড়া হতে থাকে।

ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত জনতা রাস্তায় কয়েকটি গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়।

পুলিশ বাহিনীও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে ও লাঠিচার্জ শুরু করে।

এরপর ব্যাপক সহিংসতায় অন্তত তিনজন নিহত হয় এবং পুলিশেরও ৩০ জনের মতো কর্মী জখম হয়।

মোরাদাবাদের ডিভিশনাল কমিশনার অঞ্জনেয় কুমার সিংকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, নিহত তিনজনের নাম নাঈম, বিলাল ও নোমান।

তিনি জানান, যে পুলিশকর্মীরা আহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে পুলিশ সুপারের ‘গানার’ বা বন্দুকধারী রক্ষীও আছেন।

এর আগে এদিন সকাল সাড়ে ৭টায় মসজিদ চত্বরে সার্ভের কাজ শুরু হয়।

যে মামলার জেরে সার্ভে

মুঘল আমলে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির ভেঙে এই জামা মসজিদ নির্মিত হয়েছিল এবং এখন তা হিন্দুদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে - এই দাবি নিয়ে একদল আবেদনকারী আদালতের শরণাপন্ন হলে এই সার্ভের নির্দেশ দেয়া হয়।

ওই আবেদনকারীদের যুক্তি ছিল, ‘বাবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরী’র মতো ঐতিহাসিক গ্রন্থেই প্রমাণ আছে যে ১৫২৯ সালে মুঘল বাদশাহ বাবর সম্ভলে হিন্দু মন্দির ভেঙে ওই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

এই ‘ঐতিহাসিক সত্য’টি উদ্ঘাটন করার জন্যই শাহী জামা মসজিদে সার্ভে চালানো প্রয়োজন বলে তারা দাবি করে আসছিলেন।

অন্যদিকে মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও সার্ভের বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, ভারতের ধর্মীয় উপাসনালয় আইন ১৯৯১ অনুসারে দেশের স্বাধীনতার সময় কোনো মন্দির, মসজিদ বা গীর্জার চরিত্র যা ছিল তা বদলানো যায় না – সুতরাং সম্ভালের জামা মসজিদেও এই ধরনের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়।

তাছাড়া মসজিদে এভাবে ‘সার্ভে’ চালানো হলে তা এলাকায় অযথা উত্তেজনা ছড়াবে বলেও তারা যুক্তি দিচ্ছিলেন।

পুলিশের বক্তব্য

গত মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) আদালতের নির্দেশে ওই মসজিদে যখন প্রথম দফার সার্ভে চালানো হয়েছিল, সেদিনই সম্ভলে বেশ উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। তবে এদিন (রোববার) সহিংসতার মাত্রা ছিল অনেক বেশি ব্যাপক।

সম্ভালের পুলিশ সুপার কৃষ্ণকুমার বিশনোই রোববার সন্ধ্যায় জানান, ‘ভিড়ের মধ্যে থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হচ্ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতেই মৃদু বলপ্রয়োগ করা হয়েছে এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়েছে।’

‘সহিংসতায় যারা যুক্ত ছিল তাদের আমরা চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব,’ বলেন তিনি।

ইতোমধ্যে মোরাদাবাদ ডিভিশনের পুলিশ প্রধান অঞ্জনেয় কুমার সিং জানিয়েছেন, এই হামলায় জড়িত থাকার কারণে তিন নারীসহ মোট ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বাইরে এই সহিংসতা সত্ত্বেও মসজিদের ‘সার্ভে’ অবশ্য পরিকল্পনামাফিক সম্পন্ন হয়েছে বলেই জানা গেছে।

মামলাকারীদের পক্ষে অ্যাডভোকেট বিষ্ণুশঙ্কর জৈন জানিয়েছেন, সার্ভে টিম পুরো সাইটের বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। আদালতের নির্দেশিকা অনুসারে ভিডিওগ্রাফি ও ফোটোগ্রাফিও করা হয়েছে।

এখন এই সার্ভে রিপোর্ট আগামী ২৯ নভেম্বর আদালতে জমা দেয়া হবে বলে কথা রয়েছে।

রাজনৈতিক বিতর্ক

এদিকে, সম্ভালের ঘটনাকে ঘিরে রাজ্যে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদও চড়তে শুরু করেছে।

বিরোধী সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব অভিযোগ করেছেন, উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার সম্ভলে কৌশলে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে, যাতে সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলোতে ঘটা ‘নির্বাচনী অনিয়ম’ থেকে দৃষ্টি ঘোরানো যায়!

রোববার বিকেলে তিনি নিজের এক্স হ্যান্ডল থেকে টুইট করেছেন, ‘সম্ভলে খুব গুরুতর ঘটনা ঘটেছে।’

‘এদিন সকালে একটি সার্ভে টিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে পাঠানো হয়েছিল যাতে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা ভেস্তে দেয়া যায়।’

‘তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, যাতে নির্বাচনের ইস্যু নিয়ে কোনো বিতর্ক হতেই না পারে,’ মন্তব্য করেন অখিলেশ যাদব।

সমাজবাদী পার্টির এমপি জিয়াউর রহমান বর্কও জামা মসজিদে এই সার্ভের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘সম্ভলের জামা মসজিদ একটি ঐতিহাসিক উপাসনাস্থল।’

‘দেশের সুপ্রিম কোর্টই বলেছে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় (অযোধ্যা ছাড়া) প্রতিটি ধর্মীয় স্থল যেভাবে ছিল, সেভাবেই রক্ষিত হবে।’

সুতরাং এর পরও ওই মসজিদে সার্ভের প্রয়োজনটা কী, সেই প্রশ্নই তুলেছেন জিয়াউর রহমান।

রাজ্যের শাসক দল বিজেপি অবশ্য বলছে, প্রশাসন শুধুমাত্র আদালতের নির্দেশ পালন করছে, এর মধ্যে অন্য কোনো রাজনীতি নেই।