কাজী শামসুল হক

প্রকাশিত: ২৭ মে ২০২৫ , ০১:৩৫ এ এম

অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা : পরাজিত স্বৈরশাসকের ষড়যন্ত্রের ছায়া

রাষ্ট্র যদি একটি জীবন্ত শরীর হয়, তবে রাজনীতি তার হৃদস্পন্দন। আর যদি সেই রাজনীতি হয় বারবার ক্ষতবিক্ষত ষড়যন্ত্র, বিভাজন ও ক্ষমতালিপ্সার হাতে, তবে রাষ্ট্র নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ে। আজকের বাংলাদেশ একদিক থেকে উন্নয়নের দুরন্ত অগ্রযাত্রার প্রতীক হলেও, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার অনবরত ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হচ্ছে। এই অস্থিরতা কি শুধুই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব? নাকি এর গভীরে রয়েছে অতীতে পরাজিত এক স্বৈরশাসক গোষ্ঠীর সুদূরপ্রসারী প্রতিশোধপরায়ণতা এবং বহির্শক্তির কৌশলগত স্বার্থের দৃষ্টি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় ইতিহাসের দিকে। ১৯৭৫-এর কালো অধ্যায় থেকে শুরু করে ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে বাংলাদেশ বারবার অভ্যুত্থান, ষড়যন্ত্র ও সামরিক শাসনের শিকার হয়েছে। গণতন্ত্রের বিকাশ থেমে থেকেছে বন্দুকের নলের ছায়ায়। সেই শাসকদের রাজনৈতিক উত্তরসূরিরা আজও সক্রিয়। কিন্তু এবারের যুদ্ধ আর দৃশ্যমান নয়—এ যুদ্ধ তথ্যযুদ্ধে, অর্থনীতিতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মারপ্যাঁচে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গোষ্ঠী রয়েছে যারা কখনোই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ক্ষমতায় আসেনি বা এসেও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। তারা সুনির্দিষ্ট সময় ও পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল। কিন্তু গণআন্দোলন, জনরোষ ও ইতিহাসের প্রবাহে তারা হেরে গেছে। তবে ইতিহাস বলে, পরাজিত শক্তি কখনোই নিশ্চুপ থাকে না। তারা ছায়ার মতো থেকে যায়—কখনো ইতিহাসের পুনর্লিখনের চেষ্টা করে, কখনো জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়।

এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য একটাই: বৈধ নির্বাচিত সরকারকে অকার্যকর হিসেবে তুলে ধরা, রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করা এবং আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে চাপ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করা।

বহির্শক্তির ভূমিকা : কৌশলগত শূন্যতায় হস্তক্ষেপের নীতি

বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত কেন্দ্রে—একদিকে ভারত, অন্যদিকে চীন, আর সাগরপথে ইন্দো-প্যাসিফিক রুট। ফলে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নজর সবসময় এ অঞ্চলের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া—প্রত্যেকেই চায় বাংলাদেশ যেন তাদের প্রভাববলয়ে থাকে।

এই ভূ-রাজনৈতিক খেলায় একটি বিষয় স্পষ্ট: পশ্চিমা একটি গোষ্ঠী চায় বাংলাদেশে একটি দুর্বল, নিয়ন্ত্রণযোগ্য, অনুগত সরকার। এজন্য তারা ‘মানবাধিকার’, ‘গণতন্ত্র’, ‘স্বাধীন নির্বাচন’ ইত্যাদি ইস্যু ব্যবহার করে আসছে—যা আদতে রাজনৈতিক অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। পরাজিত স্বৈরশাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে এদের স্বার্থের মিল খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

আমরা দেখেছি, কীভাবে বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, অথচ তাদের আমলে ঘটে যাওয়া গুম, হত্যা, দমনপীড়নের বিরুদ্ধে ছিল সম্পূর্ণ নীরবতা।

তথ্য ও প্রোপাগান্ডার আধুনিক যুদ্ধ

বর্তমানে রাজনীতি আর শুধু মঞ্চে সীমাবদ্ধ নেই—এটি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, ব্লগ, এনজিও রিপোর্ট আর বিদেশি সংবাদমাধ্যমের অলিগলিতে। এখানে তৈরি হয় বিকৃত ইতিহাস, কল্পিত ‘গণজাগরণ’, আর তথাকথিত ‘মানবাধিকারের’ কাহিনি। এই কাহিনিগুলোকে এমনভাবে সাজানো হয় যেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র একটি অমানবিক দানবে রূপান্তরিত হয়েছে।

এই অপপ্রচারের মূল উদ্দেশ্য হল আন্তর্জাতিক মহলে রাষ্ট্রকে ‘নির্বাচন-অপটু’, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী’, ‘স্বৈরাচারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা, যাতে করে বৈদেশিক চাপের মাধ্যমে সরকারকে দুর্বল করা যায়।

অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্র ও গুজব রাজনীতি

রাজনীতির বাইরে অর্থনীতিও এই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যবস্তু। হঠাৎ হঠাৎ ডলারের কৃত্রিম সংকট, ব্যাংকিং খাতে গুজব, রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাঘাত—এসব কেবল আর্থিক ঘটনা নয়, বরং এগুলোর পেছনে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা: জনগণের আস্থা নষ্ট করা, বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে অস্থির করা।

বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করছে, ঠিক তখনই এই অস্থিরতা নতুন করে প্রশ্ন তোলে—এটি কি কাকতালীয়, না কি পরিকল্পিত?

এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের করণীয় একাধিক স্তরে।

প্রথমত, অভ্যন্তরীণ ঐক্য। রাষ্ট্রশক্তি ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব যত কম হবে, ষড়যন্ত্র তত দুর্বল হবে।

দ্বিতীয়ত, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। সরকারকে তার নৈতিক অবস্থান দৃঢ় রাখতে হবে, যাতে প্রোপাগান্ডা ধাক্কা খায় বাস্তবতার সামনে।

তৃতীয়ত, কূটনৈতিক দক্ষতা। আন্তর্জাতিক মহলে কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করা জরুরি।

এ ছাড়া তথ্যযুদ্ধ মোকাবিলায় দরকার সঠিক ও সুসংহত রাষ্ট্রীয় বার্তা—যা দেশের মধ্যেই নয়, বিশ্বের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে ছড়িয়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর নিছক ক্ষমতার লড়াই নয়। এটি বহুস্তরীয়, বহুমুখী এক যুদ্ধ, যার শিকড় ইতিহাসে, ডালপালা বর্তমানে, এবং ফলাফল নির্ভর করছে ভবিষ্যতের উপর। এই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে হলে দরকার সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও ঐক্য।

রাষ্ট্রকে এখনই চিনতে হবে— এই অস্থিরতা কাদের দ্বারা, কেন পরিচালিত হচ্ছে, এবং কীভাবে তা প্রতিরোধ করা যায়। নইলে অর্জিত অগ্রগতি একদিন ষড়যন্ত্রের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়বে।