প্রকাশিত: ০৫ জুলাই ২০২৪ , ০৫:৪৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
আওয়ামী লীগের ৭৫তম বছরপূর্তি ২৩ জুন। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক নীতির পাশাপাশি দলটি মূল্যবোধভিত্তিক একটি পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। এর শুরু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সময় থেকে এবং ১৯৭০ সালে দলটির নির্বাচনি ইশতেহারে এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন যে বৈশ্বিক শক্তির দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকা একান্ত প্রয়োজন এবং এজন্য জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা একান্ত কাম্য। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংগ্রামে সমর্থন দেবে আওয়ামী লীগ এবং এর নীতি হবে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’
প্রতিবেশীসহ সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ জন্য অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানের ওপর সর্বোচ্চ জোর দিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা, দর্শন এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কীভাবে ওই নীতি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন, তা বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর অত্যন্ত কাছ থেকে দেশের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন দেখেছেন তিনি। তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ এখানে দেওয়া তুলে ধরা হয়েছে। সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি বাংলা ট্রিবিউনের ইউটিউব চ্যানেলে দেখা যাবে।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির বিকাশ
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বঙ্গবন্ধু জীবনের একটি বড় অংশ জেলে কাটিয়েছেন। রাজনীতির যে সময়টুকু তিনি বাইরে ছিলেন, সেখানেও আওয়ামী লীগের দায়িত্ব এবং এর সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে। ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সময় অন্যদের তুলনায় কম ছিল।
আমার সীমিত গবেষণায় যেটি আমি পেয়েছি, ১৯৫৫ সালে বাংডাং কনফারেন্স হয়েছিল এবং সেটিই পরবর্তী সময়ে জোটনিরপেক্ষ বা নন-অ্যালাইনমেন্ট মুভমেন্ট (ন্যাম) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ওই সময় ভারত, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, মিসর এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তখনও চীন জাতিসংঘের সদস্য পদ পায়নি এবং অনেক রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু তারপরও চীনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এই গোটা বিষয়টি কোনও না কোনোভাবে বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করেছিল।
বঙ্গবন্ধু আমার হিসাবে ৩২ বছর বয়সে মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং পরে ছেড়েও দিয়েছিলেন দল পুনর্গঠনের জন্য। ওই সময়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তার মধ্যে ছিল চীনে ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলের সম্মেলন। সেখানে তরুণ বঙ্গবন্ধু মাও সে তুং, চৌ এন লাই’র সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে চীনের ভূমিকা ভিন্ন ছিল। কিন্তু সেটি অন্য প্রসঙ্গ এবং এটি তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) গড়ে উঠতে সহায়তা করেছে।
দ্বিতীয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফ্লেচার স্কুলে তরুণ নেতাদের জন্য একটি প্রোগ্রামে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখনকার ছবিগুলো যদি আপনি দেখেন, তবে দেখবেন—তরুণ সুদর্শন বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে বা সোফায় বসে কথা বলছেন এবং অন্যরা শুনছেন। মানুষটি যেখানে গেছেন, সেখানেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে গেছেন।
একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কূটনীতির বিভিন্ন উপাদান, যেমন- তত্ত্ব বা নীতি বা রীতি, সেটি থাকতে হবে। এ বিষয়টি তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন হচ্ছে—ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে গিয়েও ‘আমি উচ্চস্বরে বলছি যে আমি নিরপেক্ষ থাকবো।’ এটি বলাটা সহজ নয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচন
১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে এবং তারা প্রথমবারের মতো নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছিল। ওই ইশতেহারে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কী ভাবছে, সেটি পরিষ্কার করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু তাঁর পররাষ্ট্রনীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছিলেন। জোটনিরপেক্ষতা, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শান্তি ও সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, এ বিষয়গুলো তিনি নির্ধারণ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিসহ ওই ইশতেহারে যে ২২ দফা বক্তব্য ছিল, সেটিকে জনগণ গ্রহণ করেছিল এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তারা সেটি মেনে নেয়নি।
প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম দর্শন ছিল—সব দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অবস্থান, বিশেষ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলে সেটি জনগণের জন্য সবচেয়ে বেশি মঙ্গলজনক। এ জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দ্বন্দ্ব নিরসন করা।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ পরবর্তী মেয়াদে সফলতার সঙ্গে এই দর্শন বাস্তবায়ন করছেন। শেখ হাসিনা মশাল বাহকের মতো বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
আমরা একদম সাম্প্রতিক মিয়ানমারের ঘটনাবলির দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখবো যে গত কয়েক বছর ধরে তাদের পক্ষ থেকে যেরকম উসকানিমূলক আচরণ ছিল, সেটির বিপরীতে আমরা কেন বৈরী আচরণ করছি না, সেটি বাংলাদেশের জনগণকে আমাদের বোঝাতে এবং শান্ত রাখতে হয়েছে। এখন দেখেন, যারা গোলাগুলি করেছিল, তারাই বাংলাদেশে এসে জীবন বাঁচাচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে এবং এর প্রভাব বাংলাদেশে এসেও পড়ছে। এখন চিন্তা করেন, সংযত আচরণ না করে আমরা যদি নিজেরাই কোনও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ি, তাহলে এর পরিণতি কী হতে পারে। আওয়ামী লীগ তার পররাষ্ট্রনীতির দর্শনের আলোকে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দর্শনের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এই শান্তিপূর্ণ উদ্যোগ আওয়ামী লীগ নিয়েছে এবং এখান থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক কিছু দেখার এবং শেখার আছে।
বাংলাদেশ ছোট দেশ নয়
আমরা ভুল সময়ে বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্ম। আমাদের সময়ে জনসংখ্যাকে সমস্যা হিসেবে মনে করা হতো এবং বাংলাদেশকে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। একসময় কোনও পরিবারের শিশুদের এক জোড়া জুতা থাকলে তাদের অবস্থাসম্পন্ন বলে মনে করা হতো। এখন বেশিরভাগ পরিবারের বাচ্চাদের একাধিক জোড়া জুতা রয়েছে। কিন্তু এর মাঝখানে অনেক গল্প রয়েছে, অনেক ত্যাগ রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের ৩৪তম বৃহত্তম রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ। এর আগে আছে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর। ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৩তম অর্থনীতি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শাহরিয়ার আলমের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিবেদক শেখ শাহরিয়ার জামান
শাহরিয়ার আলমের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিবেদক শেখ শাহরিয়ার জামান
পৃথিবীতে ৩০ থেকে ৩৫টি দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। কারণ, এর জন্য ৭০টিরও বেশি কমপ্লায়েন্স থাকা দরকার এবং সেটি বাংলাদেশ করতে পেরেছে। আমাকে একবার একটি শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, “আপনারা কি বুঝতে পারছেন, আপনারা এখন ‘এলিট ক্লাবের’ সদস্য।” কারণ, পৃথিবীর প্রায় ২০০টির মতো রাষ্ট্রের ভেতরে মাত্র ৩০টির বেশি দেশ এর সদস্য। সুতরাং, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নয়।
সবার জন্য গৃহনির্মাণ, সবার জন্য বিদ্যুৎ, শতভাগ শিশুর স্কুলে অংশগ্রহণের মতো বৃহৎ মানবাধিকারের বিষয়গুলো আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে এবং সীমিত সম্পদ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সেটি চর্চা করছেন। আওয়ামী লীগ এটি করতে পেরেছে এবং করে যাচ্ছে। আপনি যদি অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল হোন, তাহলেও আপনাকে মানতে হবে আওয়ামী লীগ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করি এবং এটি অত্যন্ত দুর্লভ ঘটনা যে বাংলাদেশ কোনও নির্বাচনে হেরে গেছে। আমরা জেনেভাতে মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য হয়েছি সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে। বাংলাদেশের একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে এবং দেশটির ওপর অন্য দেশগুলোর যে আস্থা রয়েছে, এটি সেটির বহিঃপ্রকাশ।