প্রকাশিত: ০৭ জুলাই ২০২৪ , ০৪:১৬ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

ফের আমলাতন্ত্রের খপ্পরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার

মানুষ যখন থেকে রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বসবাস শুরু করেছে, তখন থেকেই শাসকদের সুবিধার্থে আমলা নামক একটি সম্প্রদায়ের জন্ম হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে দেশে দেশে যেমন শাসনব্যবস্থাই থাকুক না কেন, আমলাদের কার্যকর উপস্থিতি অপরিহার্য। আমলারা সাধারণত রাষ্ট্রের উঁচু স্তরের করণিকের দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রণীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই তাঁদের প্রধান কাজ।

নীতিনির্ধারকরা তাঁদের কাজের সুবিধার্থে আমলাদের পরামর্শ চাইতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি যখন বিপরীত হয়, তখন রাষ্ট্রে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়; যার ফলে রাষ্ট্রের শাসক বা সরকারকে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। নীতিনির্ধারকদের সুপরামর্শ না দিয়ে নিজেদের মতবাদ তাঁদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাঁদের যখন জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, তা হয়ে ওঠে আমলাতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে অনেক কারণের মধ্যে ছিল দেশটিতে ভয়াবহ আমলাতন্ত্রের জন্ম ও বিকাশ।

বিশ্বে সব দেশেই আমলারা খুবই ক্ষমতাশালী। তবে বাংলাদেশের মতো ক্ষমতাশালী আমলা বিশ্বে খুব বেশি দেশে নেই। রাষ্ট্রের জন্য আমলাতন্ত্র কত মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে, তা বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামে এক সুধী সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

এত দিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমলা তৈরি করেছে, মানুষ তৈরি করেনি।’ আমলাদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার কিছু তথ্য পাওয়া যায় তাঁর সঙ্গে যেসব ব্যক্তি তখন কাজ করেছেন, তাঁদের লেখা থেকে। এই সব গুণীজনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম অন্যতম।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিভিন্ন মেয়াদে যখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি সমাজের বঞ্চিত মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য অনেক যুগান্তকারী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন। বিধবা ভাতা, বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান, গৃহহীনদের জন্য ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের ব্যবস্থা করা, কৃষিকাজের জন্য সরকারি খাসজমি বণ্টন, দেশ থেকে অশিক্ষা দূর করার জন্য নানা ধরনের বৃত্তি চালু করা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি করার মতো প্রকল্প বদলে দিয়েছে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান।

এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্যও ঠিকানা করে দিয়েছেন। এসবের সঙ্গে আছে চোখ-ধাঁধানো যত সব অবকাঠামোগত উন্নয়ন।

https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/07.July/07-07-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpgঅতীত অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, যখন একটি জনবান্ধব সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যস্ত থাকে, ঠিক তখনই আমলাতন্ত্র সরকারকে বেকায়দায় বা অস্বস্তিতে ফেলার জন্য নানা ফন্দিফিকির করে। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলারা ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস থেকে আসা, যদিও তাঁদের প্রশিক্ষণ হয়েছিল নিজেদের অত্যন্ত ক্ষমতাধর প্রভু হিসেবে জনগণের সামনে হাজির করা। তার পরও তাঁদের মধ্যে বেশ কজন আমলা বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন। আরেক শ্রেণির আমলা ছিলেন, যাঁরা চিন্তা-চেতনায় মনেপ্রাণে ছিলেন পাকিস্তানি ভাবধারার। পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে এই আমলাকুল বেজায় নাখোশ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা সব সময় সচেষ্ট থাকত। চুয়াত্তরের খাদ্যসংকটের পেছনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র ছিল তা ঠিক, তবে সেই সময়ে সরকারে কর্মরত এক শ্রেণির আমলার নানা ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডও এই সংকট সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাঁদের সবাই সেনা শাসক জিয়ার সঙ্গে ভিড়ে সরকারের অংশ হয়েছিলেন। কথায় আছে, আমলারা সব সময় পরবর্তী সরকারের জন্য কাজ করেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখে তার সত্যতা মেলে। বর্তমানে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীরা সরকার ঘোষিত একটি পেনশন স্কিম তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ধর্মঘটে আছেন; যার ফলে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন বর্তমানে অচল হয়ে আছে।

সরকার এর আগে বেসরকারি চাকরিজীবী ও বেসরকারি ব্যক্তিদের জন্য ‘প্রত্যয়’ নামে একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে। যেকোনো মাপকাঠিতেই এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এমন ব্যবস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। এই স্কিমের উদ্দেশ্য ছিল যেসব প্রতিষ্ঠানে (যেমন—তৈরি পোশাক শিল্প) তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কোনো ধরনের পেনশন ব্যবস্থা চালু নেই, সরকারি উদ্যোগে একটি পেনশন ব্যবস্থা চালু করা। যেকোনো ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্ব-উদ্যোগে এই ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত হতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠানে এমন ব্যবস্থা নেই, এটি মূলত তাদের জন্যই করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা সব সময় পেনশন ব্যবস্থার আওতায় ছিলেন। কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই অনেকটা হঠাৎ করেই ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় এই স্কিমে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এক অচলাবস্থাই শুধু সৃষ্টি করেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাজীবীদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শিক্ষকরা যেসব যুক্তি দিয়ে এই প্রজ্ঞাপনের বিরোধিতা করছেন, তা তাঁরা এরই মধ্যে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন; যার সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই। পুরো বিষয়টি যে দেশের এক শ্রেণির আমলার কারসাজি, তা স্পষ্ট বোঝা যায়, যখন দেখা যায় তাঁরা নিজেদের এই স্কিমের বাইরে রেখেছেন। বলছেন, আগামী বছর থেকে নাকি তাঁরাও এর অন্তর্ভুক্ত হবেন। আপাতত বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ওপরই এই অপরিণামদর্শী পরীক্ষা চালানো যেতে পারে। এক শ্রেণির আমলা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে বোকা পেশাজীবী। সুতরাং তাঁদের ওপর এ রকম যেকোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হোক।

এখন একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। এই মুহূর্তে এটি করার ইচ্ছা ছিল না, তবে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তা করাটা যুক্তিসংগত মনে করি। ২০১৬ সালে সরকার নতুন বেতনকাঠামো (পে স্কেল) ঘোষণা করে। ঐতিহাসিকভাবে এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এখতিয়ার আমলাদের। সরকার আমলাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি (পে কমিশন) করে দেয়। সঙ্গে দু-একজন বিশেষজ্ঞও থাকতে পারেন। এই কমিটির সদস্যরা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা যা সঠিক মনে করেন সে মতেই সব সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব সময় তাঁরা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেন। নতুন পে স্কেল যখন ঘোষণা করা হয়, তখন দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা টাইম স্কেলের যে একটি সুবিধা পেতেন, তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আমলারা তাঁদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা আরো বেশ কয়েক ধাপ উন্নীত করে নিয়েছেন। টাইম স্কেল হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসরদের ২৫ শতাংশ শিক্ষক স্কেলের সর্বোচ্চ বেতন পাবেন। সিদ্ধান্তটি হয়েছিল একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। টাইম স্কেল বাতিলের সংবাদটি জানাজানি হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে তা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এমন হয় যে শিক্ষকরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। বন্ধ হয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম। এতে আমলাদের তেমন কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তাঁদের সন্তানদের প্রায় সবাই বিদেশে পড়ালেখা করে। এই পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গে পুলিশ সপ্তাহের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হয়। তিনি কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চান পে স্কেল নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কেন এই অসন্তোষ। আমি যেহেতু পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কিছু জানি না, তাঁকে আমার অজ্ঞতার কথা বলি। তিনি জানতে চান পে কমিশন আমার কোনো পরামর্শ নিয়েছিল কি না। আমি তাঁকে জানাই তাদের সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। তিনি কিছুটা অবাক হয়ে যান।

পরদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, যিনি আবার এই কমিশনের সঙ্গে সংযুক্ত আমাকে ফোন করে বলেন, তিনি আমার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনকাঠামো নিয়ে কথা বলতে চান। আমি তাঁর কাছ থেকে দুই দিন সময় নিই। যোগাযোগ করি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গে। তাঁরা টাইম স্কেল বাতিলের বিষয়টি আমাকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বুঝিয়ে বলেন। জানতে চাই তাঁরা কী হলে সন্তুষ্ট? উত্তরে বলেন, বাতিল না করে ৫ শতাংশ দিলেও তাঁরা সন্তুষ্ট। আমি বেশ অবাক হই। কিছু আমলার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আত্মসমর্পণ করবেন? আমি নিজে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে সোচ্চার ছিলাম, আন্দোলন করেছি। জিয়া যখন দেশে সামরিক আইন জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেন, তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে সব বাধা অতিক্রম করে রাজপথে তাঁর বিরুদ্ধে মিছিল করেছি। এরশাদ দেশে জরুরি আইন জারি করে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে তাঁর সেই সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছি। পরে এরশাদের মন্ত্রিসভার এক সদস্য আমাকে বলেছিলেন, মন্ত্রিসভায় এরশাদ আমার নাম করে কিছু কটুবাক্য ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কি দেশের ভেতর আরেক দেশ?’ এরশাদের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সম্মিলিতভাবে ফেডারেশনের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছেন। সেই শিক্ষকরা কেন কিছু আমলার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন? আমি ফেডারেশনের নেতাদের বলি, হলে ২৫ শতাংশই হবে।

পে কমিশনের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিচের স্তরের শিক্ষকদের চেয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ উল্টো পিরামিড বলতে যা বোঝায়। যা মোটেও সত্য নয়। অথচ ওই সময় আমলাদের ঘন ঘন এত পদোন্নতি হচ্ছিল যে সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে সচিবালয়ে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সচিবদের বসার জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। দু-একটি জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে কার্টুনও ছাপা হয়েছে। আমার এক সহকর্মী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের কয়েকটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদমর্যাদা অনুপাতে শিক্ষকদের অবস্থানের একটি লেখচিত্র তৈরি করে দিলেন। সঙ্গে হিসাব করে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষকদের ২৫ শতাংশকে টাইম স্কেলে বেতন দিলে কত টাকার প্রয়োজন হবে। পূর্বনির্ধারিত দিনে বিকেল ৫টায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আমার সহকর্মীদের নিয়ে হাজির হলাম। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, তিনি ছাড়া আরো চারজন সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। আমরা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম শুধু আমিই কথা বলব। প্রয়োজনে আমার সহকর্মীরা আমাকে সহায়তা করবেন। বিষয়টি হয়ে দাঁড়াল একদিকে আমরা পাঁচজন শিক্ষক, অন্যদিকে পাঁচজন সিনিয়র সচিব। আলোচনা শুরু করলেন সেই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। বললেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন দ্রুততম সময়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে যেন সমস্যাটির সমাধান বের করা হয়। তাঁদের বলি, এই বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তাঁরা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবেন, তা নিশ্চয় কাম্য নয়। আমি আগে থেকেই সবার জন্য বিস্তারিত তথ্যসহ পৃথক ফাইল করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে এই বিষয়ে সরকারের আগের প্রজ্ঞাপনটি কপি করে নিয়ে যাই। প্রজ্ঞাপনটির বিষয়ে আমার সহকর্মীদেরও আগে থেকে জানাইনি।

আলোচনায় মনে হচ্ছিল পে কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সচিব ও অন্যরা তাঁদের অবস্থান পরিবর্তন করতে নারাজ। বুঝতে পারছিলাম আমার সহকর্মীরা একটু চিন্তিত। কিছুটা হতাশও। ঘণ্টা দুই আলোচনা শেষে আমি আমার কাছে থাকা সরকারি প্রজ্ঞাপনটি বের করি। জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা ছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকরা ২৫ শতাংশ টাইম স্কেল পাওয়ার যোগ্য হইবেন।’ যখন কোনো বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এই বিষয়ে আগের সব সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়, যা এ ক্ষেত্রে করা হয়নি। এটি ছিল একটি পদ্ধতিগত ত্রুটি। বলি, এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার আগের প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে হবে। তা না হলে বিষয়টি সাংঘর্ষিক হয়। সেদিন কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা শেষ হয়। তাঁরা বলেন, আগের প্রজ্ঞাপনটিসহ সভার কার্যবিবরণী তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করবেন। কয়েক দিন পরেই জানা গেল, আমরা যা চেয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রী তা-ই অনুমোদন করেছেন। শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে যান। সেদিনের সেই আমলাদের দু-একজন বর্তমানে সংসদ সদস্য, গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছেন বাকিরা। বাংলাদেশের প্রশাসনিক আমলারা বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র আমলাকুল, যারা কখনো অবসরে যায় না। আর যারা যায়, বুঝতে হবে তাদের ভাগ্য খারাপ।

এই ঘটনার উল্লেখ করা আমার বা আমাদের কাজের জন্য বাহবা পাওয়ার জন্য নয়। ঘটনাটির উল্লেখ করা শুধু এটি বোঝানোর জন্য যে দেশে এক শ্রেণির আমলা আছেন, যাঁদের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে অনেক সময় সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল পেশাজীবীদেরও সরকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেতে হয়। সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল পেশাজীবীদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার এক অবিনাশী ক্ষমতা আছে দেশের এক শ্রেণির আমলার। এরই মধ্যে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আন্দোলনরত শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান খোঁজার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হয়। তবে এটি আমি নিশ্চিত, শিক্ষক নেতারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললে সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামোর দাবি বহুদিনের। দেশের অনেক পেশার মানুষের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো থাকতে পারলে শিক্ষকদের জন্য কেন নয়? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সর্বনিম্ন। আফ্রিকার অনেক দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের দেশের শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা সব সময় শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল। অভিজ্ঞতা বলে, এই সমস্যার সমাধানও তাঁর হাতে।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক