বিবিসি বাংলা :

প্রকাশিত: ০৬ ডিসেম্বার ২০২৪ , ০৫:১৩ এ এম

অনলাইন সংস্করণ

এরশাদ পতনের পর তিন জোটের রূপরেখার যেভাবে ব্যর্থ হয়

তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘দালিলিক ভিত্তি’ ছিল আন্দোলনরত তিন জোটের ঘোষিত রূপরেখা। তখনকার আন্দোলনকারী ও বিশ্লেষকদের মতে এটি ছিল ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনীতি-রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল’, যা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।

তখন যে তিনটি জোট ওই রূপরেখা প্রণয়ন ও ঘোষণা করেছিল সেগুলো হলো, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট এবং বাম ঘরানার দলগুলোর সমন্বয়ে পাঁচ দলীয় জোট।

এর বাইরে একই দাবিতে জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন করেছিল, তবে তারা কোনো জোটে ছিল না।

এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠলে ওই বছরের ১৯ নভেম্বর জোট তিনটি আলাদা সমাবেশ থেকে একযোগে রূপরেখাটি ঘোষণা করে, যার মূল লক্ষ্য হিসেবে – ‘একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ গঠনের লক্ষ্যে এরশাদের পতন’কে তুলে ধরা হয়েছিল।

রূপরেখাটি ঘোষণার ১৭ দিনের মাথায় ওই রূপরেখার ভিত্তিতেই এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন।

রূপরেখায় থাকা ঘোষণা অনুযায়ী, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘ওই রূপরেখার সাফল্য হলো এরশাদের পতন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হওয়া। কিন্তু পরে দুই প্রধান দল নিজেদের রূপরেখাকে শুধু উপেক্ষাই করেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টো কাজ করেছে।’

আর বেসরকারি সংস্থা সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলছেন রূপরেখায় করা অঙ্গীকার ১৯৯১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত দলগুলো মেনে চললেও পরে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন ছাড়া আর কিছুই হয়নি। বরং পুরো উল্টো পথে গেছে দলগুলো, যার পরিণতি হলো এবারের গণঅভ্যুত্থান।

কিভাবে রূপরেখাটি প্রস্তুত হয়েছিল

রূপরেখা তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন কিংবা খুব কাছ থেকে দেখেছেন এমন কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে রূপরেখা তৈরি সম্পর্কে কয়েক ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।

এরশাদবিরোধী তিন জোটের মধ্যে আলোচনা ও কর্মসূচি সমন্বয়ের জন্য গঠিত লিয়াজোঁ কমিটিতে ছিলেন বিএনপির এখনকার জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি  বিবিসি বাংলাকে বলছেন এই লিয়াজোঁ কমিটিই রূপরেখাটি চূড়ান্ত করেছিল।

সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, তখনকার তিন জোটের নেতাদের পরামর্শে রূপরেখার খসড়াটি তিনিই দাঁড় করিয়েছিলেন, যা পরে তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটিতে পরিমার্জন করার পর বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন পেয়ে চূড়ান্ত হয়।

অন্যদিকে নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একজন নুর আহমেদ বকুল বলছেন, তারা তখনকার আওয়ামী লীগ নেতা টাঙ্গাইলের মরহুম আব্দুল মান্নানের ঢাকার বাসায় রূপরেখাটির খসড়া দেখেছিলেন। বকুল এখন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।

আবার আরেকটি বর্ণনায় জানা যায়, রূপরেখাটির একটি খসড়া হাতে লিখেছিলেন রাশেদ খান মেনন। এর ভিত্তিতে তিনটি জোটে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। পরে এর ভিত্তিতে ড. কামাল হোসেন, মরুহুম আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও আব্দুল মান্নান খসড়াটি পরিমার্জন করেন।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে আব্দুস সালাম তালুকদার, আব্দুল মতিন চৌধুরী, খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ আরো কয়েকজন এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন।

এটিই পরে তিন জোটকে দেয়া হয় নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য। জোটগুলো নিজেরা আলোচনা শেষে লিয়াজোঁ কমিটি তা চূড়ান্ত করে। এরপর তিন জোটের আলাদা আলাদা সমাবেশ থেকে রূপরেখা ঘোষণা করা হয়।

তবে এ রূপরেখার পটভূমি ছিল ১৯৮৮ সালের নির্বাচন। যার পর থেকেই এরশাদবিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করে।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছিল। তখন নির্বাচনে মাত্র ছয়টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল।

আন্দোলন ব্যাপক গতি পায় ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে এবং আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যেও ইস্যুভিত্তিক ঐক্য গড়ে ওঠে। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও দু’টি জোট হয় তখন।

এর মধ্যে ১০ অক্টোবর ছাত্রদল নেতা জিহাদ মারা যাওয়ার পর জিহাদের মরদেহ সামনে রেখেই ২৪টি ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করে। এরপর ২৭ নভেম্বর গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হলে এরশাদের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মূলত এই ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বেই তুমুল আন্দোলন হয়, যার জের ধরে নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে পদত্যাগে সম্মত হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

কিন্তু এর আগে থেকেই এরশাদ কিভাবে পদত্যাগ করবেন বা কার কাছে পদত্যাগ করবেন, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ, এরশাদ পদত্যাগ করলে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদের কাছেই করতে হতো।

তখনকার সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা নুর আহমেদ বকুল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ চাই ও এরশাদের পতন চাই-এমন দাবি ছাত্রদের মধ্য থেকেই উঠেছিল। এ কারণে একটি রূপরেখার কথা ওঠে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বৈঠকে। মরহুম মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল মান্নানের বাসায় এ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ আন্দোলনরত দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। এর মধ্য দিয়েই রূপরেখাটি তৈরির কাজ শুরু হয়।’

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছেন যে নেতাদের আলোচনার ভিত্তিতে রূপরেখার খসড়ার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল এবং ওই কমিটিতে থেকে তিনিই খসড়াটি লিখেছিলেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর কিভাবে করবে, নির্বাচন কিভাবে হবে এবং নির্বাচনের পর দেশ ও রাজনীতি কিভাবে এগুবে সেগুলোর ভিত্তিতে একটা খসড়া তৈরি করলাম। আমরা তাতে তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা লিখেছিলাম। পরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পরামর্শে ‘তিনটি নির্বাচন’ বাদ দিয়ে শুধু পরবর্তী নির্বাচনের কথা লেখা হয় রূপরেখায়।’

গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ অবশ্য বলছেন, রূপরেখাটিতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও নির্বাচনের দিক নির্দেশনার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পূর্ণ ছিল। তবে এতে জোটগুলো কোনো স্বাক্ষর করেনি। তারা তখন সমাবেশ থেকে ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর না থাকায় ঐক্যমত থাকা সত্ত্বেও এটি একটি জাতীয় সনদ হতে পারেনি।

কী বলা হয়েছিল রূপরেখায়

তিন জোটের রূপরেখার যে প্রচারপত্র তখনকার সরকার-বিরোধী আন্দোলনরত দলগুলো প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা যায় যে শুরুতে রূপরেখার লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছিল, ‘স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের দুঃশাসনের কবল হতে মুক্তিকামী জনগণ এরশাদ সরকারের অপসারণের দাবিতে এবং দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা ও জীবনপদ্ধতি কায়েম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলমান গণআন্দোলনে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ এক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তখনকার সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন। টানা নয় বছর ক্ষমতায় থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

এই নয় বছর এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছিলে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে শেষ পর্যন্ত তার পতন হয়েছিল তুমুল ছাত্র বিক্ষোভে। নয় বছরের ওই আন্দোলনের কর্মসূচিতে মারা গেছে ৩৫০-এর বেশি মানুষ।

তিন জোটের রূপরেখায় আরো বলা হয়েছিল যে ‘এই সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে একটি প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।’

এরপরেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেই কেবল আন্দোলনরত জোটগুলো অংশ নেবে বলে বলা হয় রূপরেখায়।

‘দেশবাসী বুকের রক্ত দিয়ে যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলো হত্যা, ক্যু প্রভৃতি অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা বদলের অবসান ঘটিয়ে সাংবিধানিক পন্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল ও হস্তান্তর নিশ্চিত করা। এজন্য আমাদের সংগ্রামের দাবির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা করা।’

‘কিন্তু অসাংবিধানিক ধারায় অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী এরশাদ সরকার প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ছলে-বলে-কৌশলে তার ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে কুক্ষিগত রাখার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অতীতের প্রতিটি নির্বাচনে ভোট চুরি, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, এমনকি নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু এবং অবশেষে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের অব্যাহত প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছে।’

রূপরেখায় জোটগুলো দৃঢ় অঙ্গিকার করে যে তারা মনে করে এই সরকারের (তখনকার এরশাদ সরকার) অধীনে কোনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।

‘এরশাদ ও অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচনে আমরা ১৫, ৭ ও ৫-দলীয় ঐক্যজোট অংশ গ্রহণ করব না, তা রাষ্ট্রপতি বা সংসদ যেকোনো নির্বাচনই হোক না কেন। এসব নির্বাচন শুধু বর্জনই নয়, প্রতিহতও করব। একমাত্র একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আমরা ১৫, ৭ ও ৫-দলীয় ঐক্যজোট কেবলমাত্র সার্বভৌম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অংশ গ্রহণ করব।’

পরিণতি যা হলো

রূপরেখায় যা লেখা হয়েছিল সেভাবেই একজন নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে তিন জোট তখনকার প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নাম চূড়ান্ত করে এবং তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করে তার কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এরশাদ।

সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকার একাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে এবং সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। পরে ওই সংসদেই রূপরেখায় থাকা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির বদলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার করা হয় সংবিধান সংশোধন করে।

বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, তিনি মনে করেন এই রূপরেখাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং এতে প্রধান দলগুলো কয়েকটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছিল।

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল তারা একটি আচরণবিধি দিয়েছিল রূপরেখায়। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন ছাড়া আর কিছুই হলো না। সংসদও অকার্যকর হয়ে গেলো। ফায়দাভিত্তিক রাজনীতি শুরু হলো। সরকারি দল কর্তৃত্বপরায়ন হতে শুরু করল। আর বিরোধীরাও দায়িত্বশীল থাকল না। ধীরে ধীরে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই ধ্বসে পড়ল, যা আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিলো ২০২৪ সালে এসে।’

মূলত নির্বাচন নিয়ে রূপরেখায় করা অঙ্গীকার বড় ধাক্কা খেয়েছিল ১৯৯৪ সালে একটি সংসদীয় উপ-নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির ঘটনায়। ওই নির্বাচনের পর আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ করে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন খালেদা জিয়া।

আবার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানই তুলে দেন সংবিধান থেকে এবং তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করার পর শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তিনি।

আবার রূপরেখায় দলগুলো এরশাদের কোনো সহযোগীকে নিজ নিজ দলে না নেয়ার অঙ্গীকার করলেও একানব্বই সালের নির্বাচনেই বিএনপির হয়ে অংশ নেন এরশাদ জমানার প্রভাবশালী দুই আমলা এম কে আনোয়ার ও কাজী কেরামত আলী।

এমনকি এরশাদকে নিয়ে নির্বাচনী জোটও করেছিল আওয়ামী লীগ। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভাতেও রাখা হয় এরশাদের দল জাতীয় পার্টির নেতাদের। এছাড়া মওদুদ আহমদসহ দলটির কিছু নেতা আগেই বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। কেউ কেউ বিএনপি সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন।

রূপরেখায় বলা হয়েছিল, ‘জোটভুক্ত দলসমূহ ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকবে। জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় প্রদান করবে না এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কিন্তু বাস্তবতা হলো গত আড়াই দশকে দুই প্রধান দল ক্ষমতায় থাকার সময় পরস্পরকে নির্মূল করার রাজনীতি করেছে।’

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছেন, ‘অঙ্গীকার ছিল কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও দোষারোপ করব না। কিন্তু এগুলো কেউ মানলো না। আসলে আচরণবিধিগুলো কেউই মানলো না। আবার প্রচারণায় ধর্মকে ব্যবহার করার প্রবণতাও তারা শুরু করে ১৯৯১ সালের নির্বাচন থেকেই।’

আবার দলগুলো মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিলের অঙ্গিকার রূপরেখায় করলেও বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারগুলোর সময়ে নতুন নতুন কালো আইন করা হয়েছে, যা নিয়ে দেশে-বিদেশে তীব্র সমালোচনাও হয়েছে।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, আন্দোলনের একপর্যায়ে জনগণের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল যে আন্দোলন সফল হলে দেশে গণতন্ত্র আসবে ও দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য আসবে। কিন্তু কিছুদিন পরে রাজনীতি সেই আগের ধারাতেই ফিরে যায়। নির্বাচনে যারা জিতে তারা ‘উইনার টেকস অল’ নীতি নেয় ও বিরোধীদের স্পেস কমে যায়। বিরোধীরাও বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতার সংস্কৃতি শুরু করে। সব মিলিয়ে যে জনআকাঙ্খা তৈরি হয়েছিলে নব্বইয়ে তিন জোটের রূপরেখা ঘিরে, সেটি হারিয়ে গেলো ও মানুষ প্রতারিত হলো।

রুপরেখায় দাবি ও লক্ষ্য

এ ঘোষণার দেয়ার পর রূপরেখায় তখনকার আন্দোলনের দাবি ও লক্ষ্যগুলো দফাওয়ারি উল্লেখ করা হয়। যা পাঠকদের সুবিধার্থে নিচে তুলে ধরা হলো,

‘এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরা চলমান আন্দোলনের মূল দাবি ও লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কে ঐক্যবদ্ধভাবে নিম্নরূপ সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করছি!

১. হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী এরশাদ ও তার সরকারের শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে :

ক. সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রেখে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী তথা সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদের (ক) ৩ ধারা এবং ৫৫ অনুচ্ছেদের (ক) ১ ধারা এবং ৫১ অনুচ্ছেদের ৩ নং ধারা অনুসারে এরশাদ ও তার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলনরত তিন জোটের নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে উপ-রাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

খ. এই পদ্ধতিতে উক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মূল দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।

২. ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হবেন অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা দলের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না। তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো মন্ত্রী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না।

খ. অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার শুধুমাত্র প্রশাসনের দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনাসহ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ও দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস করবেন।

গ. ভোটারগণ যাতে করে নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেই আস্থা পুনঃস্থাপন এবং তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

ঘ. গণপ্রচার মাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশে রেডিও-টেলিভিশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং এই সংসদের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।

৪. ক. জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধানবহির্ভূত কোনো পন্থায়, কোনো অজুহাতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না।

খ. জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে।

গ. মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিল করা হবে।’

সূত্র : বিবিসি