প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বার ২০২৪ , ০৩:২১ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

দাওয়াইটা মোক্ষম ছিল, কিন্তু-

কোনো ক্রিয়ার পর তার প্রতিক্রিয়াটা যদি ত্বরিত হয় তা হলে বুঝতে হবে, ক্রিয়াটা জুৎসই, দাওয়াইটাও মোক্ষম। পাঠক হয়তো ধারণা করছেন, এই কলামে অধিকাংশ সময়ই রাজনীতি নিয়েই আলাপচারিতা হয়ে থাকে। এখন আবার দাওয়াইয়ের কথা কেন। পাঠক, ধৈর্য ধরুন। রাজনীতি নিয়েই কথা বলা হবে। আপনারা হয়তো ভুলে যাননি, গত বছর (২০২৩ সালে) ১৩ জুলাই বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে মনে রাখতে হবে, এর পেছনে একটি ধারাবাহিকতা আছে, সে ধারাবাহিকতার অনুসরণের জন্য খানিকটা ফ্লাশব্যাক জরুরি। নতুন প্রজন্ম হয়তো সঙ্গতকারণেই অনেক কিছুই ভুলে যেতে পারে। কারণ, নিকট অতীতে দেশের মানুষকে নানা দুরভিসন্ধি নিয়ে ইতিহাস থেকে দূরে রাখার অবিরাম প্রয়াস ছিল। বিএনপির স্থপতি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গত শতাব্দীর একেবারে শেষপ্রান্তে এসে রাজনীতিতে যে নতুন ধারণা ও ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, এই জনপদের মানুষের অগ্রযাত্রা, সাম্য, সহমর্মিতা সম্প্রীতি এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতায় উত্তরণের একটি পথনকশা ছিল, তখন শহীদ জিয়ার দেয়া ১৯ দফায়। এখন ৩১ দফা অবশ্যই একটি মূল্যবান কর্মসূচির দলিল। তবে এই কর্মসূচি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে কর্মপদ্ধতিটা কী হবে তার ব্যাখ্যা জরুরি ছিল। ঢাকা দেশের রাজধানী, এটি সত্য, কিন্তু ঢাকা পুরো বাংলাদেশ নয়। ঢাকায় বিএনপির বিপুল সংখ্যক কর্মী রয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ঢাকার বাইরেও গোটা দেশে দলটির অসংখ্য কর্মী রয়েছে। তাদের মুখোমুখি হয়ে কেউই এই ৩১ দফার বার্তাটা পৌঁছে দিয়েছিল বলে আমাদের জানা নেই। ৩১ দফা নিয়ে বোদ্ধাদের সাথে আলোচনা, সেমিনার হওয়া উচিত ছিল। সেখানে ৩১ দফায় আরো সংযোজন-বিয়োজনের পরামর্শ এলে কর্মসূচি সর্বজনীন ও সমৃদ্ধ হতে পারত। এমনটি হলে শুধু বিএনপির নয়, জনগণও তাতে উপকৃত হতো তথা ৩১ দফা সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারত। একই সাথে সাধারণের কাছে এই বার্তা পৌঁছে যেত যে, দলটি দেশের কল্যাণ তথা জনগণের জন্য একটি সমৃদ্ধ জীবন রচনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মনে রাখতে হবে, মানুষ সবদিক থেকেই সীমাবদ্ধ। ব্যক্তি বা সমষ্টি সে ক্ষেত্রে একটি জানালা পেত। সেই খোলা জানালা দিয়ে সমমনাদের সাথে ভাববিনিময় হতে পারত। সমমনাদেরও অনেক কিছু শেয়ার করা সুযোগ হতো। এবার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে আসা যাক।

বিএনপি যখন রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফার ঘোষণা করেছিল, তখন সব মিডিয়ায় তা ব্যাপক প্রচার লাভ করে। মানুষের ভেতরও এই ৩১ দফা নিয়ে প্রচুর আগ্রহ আর আলোচনা শুরু হয়েছিল। এতে হালে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের হয়তো পিলে চমকে গিয়েছিল। ভেবেছিল, আমরা পিছিয়ে পড়লাম কি না। দ্রুত এর এনকাউন্টার করতে লীগ সরকার তড়িঘড়ি করে ঘোষণা দিলো, ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মসূচি। দুর্ভাগ্য সেই দাওয়াইটা কেউ আর গিলল না। কেননা তার বহু আগেই ডিজিটালের চর্চাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশে। জনগণ ধরে নিয়েছিল এটি মেয়াদোত্তীর্ণ এক পণ্য যা স্র্রেফ স্ট্যান্টবাজি। এই দাওয়াই কাজে না আসায় লীগ হতোদ্যম হয়েছিল, কিন্তু হাল ছাড়েনি। তারা নতুন একটি কার্ড বোর্ডে ফেলেছিল, স্মার্ট বাংলাদেশ। লীগ ভেবেছিল এটিই হবে রাজাকে মাত করার জন্য অব্যর্থ চাল। কিন্তু বিধি বাম। লীগের সে চালে রাজা মাত হওয়া দূরের কথা, রাজার গায়ে এতটুকু আঁচড় পর্যন্ত পড়েনি। লীগের এতে স্বপ্নভঙ্গ হয়। এরপর আর কোনো তত্ত্ব নিয়ে তারা আর মাথা ঘামায়নি। তাদের মূল কার্যক্রম তথা স্বৈরাচারী প্রজেক্ট জোরদার করে এগিয়ে যেতে থাকে।

বিএনপির ৩১ দফা একটি মূল্যবান কর্মসূচি। কিন্তু সেই কর্মসূচি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, তার কর্মপদ্ধতি কী হবে তার ব্যাখ্যা করা হয়নি। যখন বোঝা গিয়েছিল ৩১ দফা মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে লীগ সরকার পিছু হটছে সে সুযোগে বিএনপির তখন ৩১ দফা নিয়ে আরো সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন ছিল। তখন কিন্তু বিএনপিতে স্থবিরতা করা গেছে। রাজনীতির অঙ্গনে তাদের কিছু তৎপরতা থাকলেও ভিন্ন ফোরামে ৩১ দফা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই জারি থাকলে, নতুন সমীকরণ দৃশ্যমান হতো। সে প্রত্যাশায় বহুজন উন্মুখ থাকলেও দলটি জনগণের মনের চাহিদা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলে মনে হয় না। বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী আউটসাইডারদের মধ্যেও এমনি প্রত্যাশা ছিল। ইতোপূর্বে জনগণের মধ্যে এ নিয়ে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল সেটিও হ্রাস পেতে পেতে শূন্যের কোটায় গিয়ে পৌঁছে। শুধু তাই নয়, রাজনীতির ময়দানে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল সেটিও আর আলোচনার বিষয় হিসেবে রইল না। বিএনপি যেন অবসাদগ্রস্ত হয়ে মগ্ন মৈনাকের মতো ঘুমিয়ে পড়ল। বহু সময় বাদে এখন বিএনপির যেন ঘুম ভেঙেছে। অতিসম্প্রতি বিএনপি বলেছে, ৩১ দফাকে ব্র্যান্ডিং করা হবে। ব্র্যান্ডিং নিয়ে দু-একটি কথা পরে বলা হবে। প্রথমত, বিএনপি তো ইতোমধ্যে ট্রেন ফেল করেছে। তার অর্থ এতকাল ৩১ দফা নিয়ে এত সময় নীরব থাকাটাই বস্তুত ট্রেন ফেল করার শামিল। ইতোমধ্যে তো ৩১ দফার শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গেছে। সবার জানা ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতা ও সর্বস্তরের সৈনিকদের যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, তারপর বিপ্লবের তোড়ে ভেসে যায় আওয়ামী স্বৈরাচার। প্রতিষ্ঠা পায় বিপ্লবী এক নতুন সরকার, সেই সরকার দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দেয় রাষ্ট্র সংস্কারের এক কর্মসূচি। যা এখন গতি নিয়ে এগিয়ে চলছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেসব কর্মসূচি নিয়ে এখন বিপ্লবী সরকার ছুটছে, তার সবই বিএনপির ৩১ দফায় রয়েছে। যেমন, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া টেকসই করা, নির্বাচনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারসাম্য বিধান, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভকে মজবুত ও সুবিন্যস্ত করা, সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, অর্থপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে পুনর্বিন্যাস করা, বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, বিচারপতি নিয়োগের বিধান প্রণয়ন করা। মানবধিকার সমুন্নত করা, অর্থনৈতিক সংস্কার, বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম দূরীকরণ, শ্রমশক্তির ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা দান, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিরক্ষাকে অগ্রাধিকার দান, জলবায়ুজনিত সঙ্কট মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।

মানুষ কিন্তু এখন আর বিএনপির মূল্যবান দলিলের কথা স্মরণ করছে না; বরং সরকারের সব সংস্কার কর্মসূচির পাশে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির জন্য এটি শুধু ট্রেন ফেল করা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। দলটি যথাসময় ঠিক কাজটি করতে খুব সক্ষম-পারঙ্গম নয়, সময়জ্ঞানে অলস। ৩১ দফা নিয়ে যে ব্র্যান্ডিং করার কথা বলা হয়েছে, তাতে এমন প্রশ্ন অনেকের মনে জেগেছে। আপনাদের ব্র্যান্ড ম্যানেজার কারা? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন, ‘অ্যাবল অল’ তার পরও তার ব্র্যান্ড ম্যানেজার ছিলেন, যাদের ব্র্যান্ডিং ক্যাপাসিটি ছিল অসাধারণ, আন-প্যারালাল যেমন- শাহ আজিজ, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মির্জা গোলাম হাফিজ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আবদুর রহমান বিশ্বাস, শেখ রাজ্জাক আলী, ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী, জামাল উদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, আবদুল মোমেন খানসহ আরো অনেকের নাম যোগ করা যাবে। এখন বিএনপির ব্র্যান্ড ম্যানেজার নেই, এ কথা বলব না। তবে শহীদ জিয়ার ম্যানেজারদের মতো গুণে-মানে সমকক্ষ তেমন ব্র্যান্ড ম্যানেজারের সংখ্যা বর্তমানে দলে প্রায় মাইক্রোস্পোপিক। এই সংখ্যা বৃদ্ধি জরুরি হলেও এখানে কিছু সমস্যা রয়েছে সেটি অস্বীকার করা যাবে না। তবে যতটুকু সমস্যা তা খুব বেশি না হলেও তার প্রচার বহু বিস্তৃত। অপকর্ম তথা চাঁদাবাজি, দখলবাজির সাথে বিএনপির কিছু নেতাকর্মীকে ট্যাগ করা হচ্ছে। এখন বহু যোগ্য সক্ষম মানুষ আছেন, যারা ক্লিন অ্যান্ড ক্রিম। যারা বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃত্ত না হলেও অনুরক্ত। তাদের বিএনপিতে আমন্ত্রণ জানালে সহজেই তারা সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন। নানা অপকর্মে বিএনপির কিছু লোককে যে ট্যাগ করা হয়েছে সে কারণে ওই সফেদ মানুষগুলো এখন বিএনপিতে যোগ দিতে দ্বিধায় পড়বে। কিন্তু বিএনপির সদর দরজা খুলে দিলে হাজারো মানুষ আগ্রহভরে দলে যোগ দিতে চাইবে। কিন্তু তাদের দিয়ে ব্র্যান্ডিং ম্যানেজারের অভাব পূরণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর এ কথা বিএনপি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করে, আজকের দিনে বিষয়টা জটিল ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণে দক্ষ ব্র্যান্ড ম্যানেজারের প্রয়োজন কতটা বেশি। শুধু দক্ষতাই শেষ কথা নয়, দক্ষতা যোগ্যতার সাথে যদি সততা ও দলের প্রতি অঙ্গীকার না থাকে, যেকোনো মুহূর্তেই বিপদ এসে দরজায় কড়া নাড়বে। দলের প্রতি-নায়কদের আত্মকলহের পরিণতির জেরই ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতবরণের অন্যতম কারণ। সেটি শুধু বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিএনপির জন্য দুর্ভাগ্যের ছিল না। গোটা জাতি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, গোটা দেশের কোটি জনতার হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়েছিল। বিএনপির দুর্ভাগ্যের রজনী ১৯৮১ সাল ৩ মে শেষ হয়নি। কারণ বিএনপির খলনায়কদের অপতৎপরতার কারণেই বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীরা তৎপর হতে পেরেছিল। বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করেছে দলে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু খলনায়ক। ফলে তাকেও যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। ওই সব ব্যক্তি বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের কেউ সরকারের প্রতিপক্ষের সাথে সখ্য বজায় রেখে চলে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, যা শুধু দৃষ্টিকটুই নয় বরং জনগণের এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে যে, বিএনপির ভেতর এখন প্রচুর দ্বিমত-দ্বিচারিতা সৃষ্টি হয়েছে। এক নেতার বক্তব্যের সাথে অপরজনের বক্তব্যের আকাশ-পাতাল ব্যবধান। একই নেতা আজ যে কথা বলছেন, কাল তিনি ঠিক তার বিপরীত বক্তব্য দিচ্ছেন। তাতে মানুষ শুধু বিভ্রান্ত নয়, তাদের কাছে এমন বার্তাই যাচ্ছে যে, নেতারা চিন্তাভাবনা করে কথা বলছেন না। যখন যার যা মনে আসে, সেটিই বলছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে কথা বলছেন না। এমন ধারণার কারণে দেশের মানুষ বিএনপি সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা ও আশা পোষণ করে সেখানে চির ধরছে।

দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে জনগণ আশা করে, বিএনপির নেতারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন। দায়িত্ব নিয়ে কথা বলবেন। সেদিকে নেতাদের নজর নেই বলে সাধারণভাবে ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে দলের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। শুধু দেশের মানুষ নয়, বাইরের দুনিয়াও এখন দলটির পরিপক্বতা পরিমাপ করছে।