প্রকাশিত: ১৬ জুন ২০২৫ , ০৪:২৫ এ এম
অনলাইন সংস্করণ
একটি দীর্ঘশ্বাস জমে আছে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে- যার উৎস এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের এক উপনিবেশিক অপরাধ, যার নাম ইসরায়েল। ইতিহাসের পাতায় যে রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল এক গোষ্ঠীর তাড়িত স্বপ্ন এবং আরেক গোষ্ঠীর রক্ত-চোখা বাস্তবতা দিয়ে, সেই ইসরায়েল আজ এক আন্তর্জাতিক সংকটের নাম। ফিলিস্তিনে অবৈধ দখলদারিত্ব, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে অস্ত্র বানিয়ে গোটা অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরির অপরাজনীতি তাকে ঘিরে রেখেছে জন্মলগ্ন থেকেই। সময় যত গড়িয়েছে, এই সংঘাত আর আঞ্চলিক সীমায় আবদ্ধ থাকেনি; তা হয়ে উঠেছে ইসলামী বিশ্বের হৃদয়ে এক বিষফোঁড়া, এবং এই বিষ এখন বিশ্বব্যবস্থার রক্তসঞ্চালনকেই বিষাক্ত করে তুলছে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যে যে অশান্তি সৃষ্টি করে, তার দায় শুধু উপনিবেশবাদীদের নয়, বরং সেই সমস্ত পশ্চিমা শক্তির যারা এটি বাস্তবায়নে কৌশলী ও ক্রমাগত ভূমিকা পালন করেছে। ব্রিটেনের ব্যালফোর ঘোষণা ছিল ফিলিস্তিনকে ইহুদি বসতির জন্য উৎসর্গ করার প্রথম উদ্যোগ, যার ফলস্বরূপ ১৯৪৮ সালে এক ভয়াবহ ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে তাদের জন্মভূমি থেকে উৎখাত করা হয়। এরপর ইসরায়েল যা করেছে তা এক কথায় বলা চলে—রাষ্ট্রীয় দখলদারিত্বের সুদৃঢ় ব্যবস্থা, আধিপত্য কায়েমের নামে ফিলিস্তিনে মানবাধিকার হরণ, বসতি স্থাপন, অবরোধ, এবং এক ধরনের আধুনিক বর্ণবৈষম্যের ‘আধুনিক আফ্রিকান মডেল’ প্রতিষ্ঠা।
এই অবিচার দেখে যারা মুখ খুলেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী দেশ হলো ইরান। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান যখন শাহের পুতুলতান্ত্রিক শাসনকে উচ্ছেদ করে আত্মমর্যাদা ও মুসলিম ঐক্যের পতাকা তোলে, তখন থেকেই ইসরায়েলের সাথে তাদের সংঘাতের বীজ রোপিত হয়। ইরান স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়- ইসরায়েল একটি অবৈধ দখলদার রাষ্ট্র, এবং ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধীনতা লাভের অধিকার রাখে। ইরান শুধু কথায় নয়- প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় ফিলিস্তিনি সংগ্রামের পাশে দাঁড়ায়। বিশেষত লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং গাজাভিত্তিক হামাসের পৃষ্ঠপোষকতায় ইরানের ভূমিকা ইসরায়েলের জন্য এক গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
যদিও ইসরায়েল বরাবরই নিজেকে আত্মরক্ষাকারী রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করে এসেছে, বাস্তবতা হলো সে নিজেই প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের নীতি চালু রেখেছে। গোপন অপারেশনের নামে ইরানে পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যার ঘটনা, সিরিয়ায় ইরানপন্থী ঘাঁটি লক্ষ্য করে নিয়মিত বোমা হামলা, গাজায় অব্যাহত অবরোধ, এবং সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহতম গণহত্যা- সবই এই আগ্রাসী রাজনীতির উপাদান। ২০২৩ সালে গাজা উপত্যকায় যে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে ৩০ হাজারের বেশি নারী-শিশু-নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে, তার জবাব দিতে ইরান যে এখন সামরিকভাবে সরাসরি মাঠে নেমেছে, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী সরাসরি ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে- যা ছিল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি দুই রাষ্ট্রের উন্মুক্ত সামরিক সংঘর্ষ। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ইরানের ইসফাহান অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। যদিও এই হামলার ক্ষয়ক্ষতি সীমিত ছিল, তবু এটিকে এক ‘রেড লাইন’ অতিক্রম হিসেবে দেখা হচ্ছে- যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের ঠান্ডা যুদ্ধ একটি সরাসরি লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে।
এই সংঘাতে শুধু ইরান ও ইসরায়েল নয়- জড়িয়ে পড়ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, কাতার, লেবানন, ইরাক এবং এমনকি পাকিস্তানও। সৌদি আরব দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে- একদিকে ইসরায়েলের সাথে চুক্তির পথে আগাচ্ছে, অন্যদিকে ইরানকে সরাসরি না হলেও কৌশলগতভাবে মোকাবিলার জন্য নিজেদের সামরিক প্রস্তুতি বাড়িয়েছে। তুরস্ক, এক সময়ের ঘনিষ্ঠ ইসরায়েল মিত্র, এখন মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে, যদিও এরদোয়ানের বক্তব্য স্পষ্টতই ফিলিস্তিনপন্থী। অন্যদিকে কাতার এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরানের মিত্র হিসেবে জোরালোভাবে কার্যকর হচ্ছে। এই বহুমুখী সঙ্ঘর্ষের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য যেন হয়ে উঠেছে এক বিস্ফোরক মঞ্চ, যেখানে একটিমাত্র ভুল পদক্ষেপ ডেকে আনতে পারে এক সর্বগ্রাসী যুদ্ধ।
পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা এই পরিপ্রেক্ষিতে শুধু পক্ষপাতদুষ্ট নয়, একেবারেই আগুনে ঘি ঢালার মতো। যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইসরায়েলকে বছরে ৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিচ্ছে এবং জাতিসংঘে বারবার ভেটো প্রয়োগ করে তাকে আন্তর্জাতিক জবাবদিহি থেকে রক্ষা করছে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো মুখে মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও ফিলিস্তিনে গণহত্যার বিরুদ্ধে কার্যত নিরুত্তাপ। আবার চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত নীরবতা এবং শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী অবস্থান এই সংঘাতের সমাধানে কোনো কার্যকর চাপ তৈরি করতে পারছে না।
এই সংঘাতের ভয়াবহতা শুধু সামরিক নয়, অর্থনৈতিকও বটে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ মানেই বিশ্ব জ্বালানি বাজারে এক বিপর্যয়। হরমুজ প্রণালি, যেখান দিয়ে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ অপরিশোধিত তেল রপ্তানি হয়, তা ইরান যদি অবরুদ্ধ করে, তবে জ্বালানি সরবরাহে এক বিরাট ধাক্কা আসবে। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গেছে। এর অভিঘাত পড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়ার দেশগুলোর রিজার্ভ, মুদ্রাস্ফীতি, আমদানি ব্যয় এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সবই চাপের মুখে পড়বে। রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এক অপরিহার্য উপাদান- এই সংঘাত তা ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে।
বিশ্ব আজ এক সংকটের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সভ্যতার নামে যে ভণ্ডতা বিশ্বরাজনীতিতে চলমান, তার নির্মম প্রকাশ ঘটছে এই সংঘাতের মধ্য দিয়ে। মানবাধিকারের নামে যাদের মুখে আলো, তাদের হাতেই রক্ত। যুদ্ধের বাজারে কৌশল, প্রতিরোধের নামে নিষ্পাপ প্রাণহানি, এবং রাজনীতির নামে নিষ্ঠুর নিষ্পেষণ- এই দুনিয়ার বাস্তবতা। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আজ যে রূপ নিচ্ছে, তা শুধু এক আঞ্চলিক সংঘাত নয়, বরং বিশ্বব্যবস্থার নৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর চরম দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি।
এই আগুন যদি থামানো না যায়, তবে তা শুধু তেল, গ্যাস, অর্থনীতিকে নয়- মানবতা ও সভ্যতাকেই গ্রাস করবে। সুতরাং, এখনই জরুরি বিশ্ব নেতৃত্বের সাহসী ও সৎ হস্তক্ষেপ। মিত্রতা নয়, ন্যায়বিচার- সামরিক সমীকরণ নয়, মানবিকতা- এই হলো একমাত্র পথ, যার মাধ্যমে এই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঠেকানো যেতে পারে। অন্যথায়, ইতিহাস আরও একবার মানুষের চিৎকার শুনবে- কিন্তু এবার আর কোনো শ্রোতা থাকবে না।