প্রকাশিত: ১১ জুন ২০২৫ , ১১:১০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। ইতিহাসের পরিসরে রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের মধ্যে বহু দশক ধরে চলমান টানাপোড়েন, বিশ্বাসঘাতকতা, শোষণ আর দুর্নীতির কদর্যতা আজও আমাদের পেছনে টেনে ধরছে, কিন্তু সেই প্রতিরোধ ছিঁড়ে ফেলতে এক নবযাত্রার উন্মেষও যেন ততোধিক দৃপ্ত। বিগত স্বৈরশাসক ও তার গোষ্ঠী একসময় রাষ্ট্রক্ষমতা অপব্যবহার করে শুধু আইন-শাসন নয়, বিবেককেও স্তব্ধ করে দিয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রশাসনিক পক্ষপাত, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ছাত্র-জনতার কণ্ঠরোধ- এসব কাহিনি আজও আমাদের সামাজিক চেতনায় বিষফোঁড়া হয়ে আছে। এই ইতিহাস শুধু অতীত নয়, বর্তমানকে বোঝার একটি আয়না।
স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসে যখন দেশ এক অন্তরবর্তী পরিবর্তনের স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছে, তখনো থেমে নেই সেই অপশক্তির ছায়া। পলাতক পরাজিত নেতৃত্ব দেশ ছাড়লেও তার মদদপুষ্ট এজেন্টরা দেশে-বিদেশে সক্রিয়। লন্ডন, দোহা, ওয়াশিংটনের অলিন্দে ঘুরে বেড়ানো ‘রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী’ নেতারা এখনো আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রমাণে মরিয়া। তাদের পিছনে আছে একদল দেশি ষড়যন্ত্রকারী- তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া কুশলী, এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী চক্র- যাদের কাছে দেশের কল্যাণ নয়, ক্ষমতা ও প্রতিশোধই মুখ্য।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তরবর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস—একজন অর্থনীতিবিদ, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজচিন্তক, যিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থেকে সমাজ বদলের অনুশীলনে ব্যস্ত থেকেছেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত অন্তরবর্তী সরকার কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, বরং একটি রাষ্ট্রনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে উদ্ভূত, যার লক্ষ্য হচ্ছে একটি অন্তর্বর্তী সময়ের ভেতর দেশে নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, এবং আস্থাশীল নির্বাচন সম্পন্ন করা। কিন্তু সেটিই যেন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে—কারণ চিরস্থায়ী ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর একটি মহল চায় না কোনো ন্যায্য গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হোক।
এই সরকার গঠনের পর থেকে দেশের ভেতরে এবং বাইরে একটি কূটনৈতিক এবং প্রশাসনিক ভারসাম্য রক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপান, কাতার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একাধিক কৌশলগত বৈঠকে বাংলাদেশের অন্তরবর্তী সরকার অংশ নিয়েছে। এই সংলাপগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দরজা যেমন খুলেছে, তেমনি দেশের শেয়ারবাজার, কৃষিনির্ভর উৎপাদন এবং বৈদেশিক বিনিয়োগেও নতুন গতি এসেছে। চীনের সঙ্গে বন্দর উন্নয়ন, জাপানের সঙ্গে মেট্রোরেল ও অবকাঠামো প্রকল্প, কাতারের সঙ্গে এলএনজি চুক্তি এবং জাতিসংঘের সঙ্গে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ককে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।
দেশের অর্থনীতি নিয়ে যারা একসময় হতাশ ছিলেন, তারাও এখন লক্ষ্য করছেন যে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় এবং কৃষিভিত্তিক প্রবৃদ্ধি- এই তিন খাতেই উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীলতা এসেছে। ২০২৫ সালের মধ্যভাগে এসে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি ৫.২% বেড়ে $৪৩ বিলিয়নে পৌঁছেছে। প্রবাসী রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে $২ বিলিয়ন প্রতি মাসে অতিক্রম করছে, যা একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বজায় রাখছে, অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করছে। সরকার ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ৭,০০০ কোটি টাকার ভর্তুকি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে এবং তহবিল বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ‘ডিজিটাল ট্র্যাকিং’ ব্যবস্থা চালু করেছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতেও নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। অন্তরবর্তী সরকারের অধীনে বিদ্যালয় পর্যালোচনা, পাঠ্যক্রম আধুনিকীকরণ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা হালনাগাদ করার কাজ চলছে। স্বাস্থ্যখাতে ডিজিটাল হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার একটি পাইলট প্রকল্প ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ ও খুলনায় শুরু হয়েছে, যেখানে রোগী রেজিস্ট্রেশন, ওষুধ সরবরাহ এবং রিপোর্ট প্রদান পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক। ওষুধ শিল্পে গুণগত মান নিশ্চিত করতে বিএসটিআইয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরীক্ষাগার মানদণ্ড সংযুক্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি তাদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট করতে পারেনি। কখনো একদলীয় সরকার বিরোধিতা, কখনো অন্তরবর্তী সরকারে অংশগ্রহণের আগ্রহ, আবার কখনো যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সঙ্গে মীমাংসার কূটনৈতিক নাটক—সব মিলিয়ে দলটি যেন আদর্শহীনতার সংকটে ভুগছে। সম্প্রতি জানা গেছে, কিছু দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থান্বেষী আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এই অন্তরবর্তী কাঠামোতে প্রভাব খাটাতে চাচ্ছে, এবং তাদের সঙ্গে বিএনপি ঘনিষ্ঠ চক্রগুলোর গোপন আঁতাতও দেখা যাচ্ছে- যা এই সরকারের নিরপেক্ষতা ও জনপ্রিয়তাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের চলমান যুক্তরাজ্য সফর শুধু আনুষ্ঠানিকতাই নয়, একটি যুগান্তকারী কূটনৈতিক সম্ভাবনাও বহন করছে। সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইনোভেশন ইন গভর্ন্যান্স’ শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি গণতন্ত্রের নৈতিক কাঠামো, মানবিক উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা তুলে ধরেন, যা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, চেম্বার অব কমার্স, এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সফরের পরপরই আশা করা হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ সফরে আসবে এবং দেশের অন্তরবর্তী বাস্তবতাকে সমর্থন করবে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তাই এক বিপরীত স্রোতের সম্মিলিত সংলাপ। একদিকে অন্ধকারের ষড়যন্ত্র—অন্যদিকে আশার প্রদীপ। এই আশাকে সঞ্জীবিত রাখতে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নাগরিক ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। অন্তরবর্তী সরকার যদি জনআস্থার ভিত্তিতে এই রূপান্তরকে সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তবে এটি কেবল একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়- বরং বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গণতান্ত্রিক নবজাগরণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এখানেই জাতির ভবিষ্যতের শেকড় রচিত হচ্ছে।