ঢাকা ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বার ২০২৪ , ০৩:২০ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

রিজার্ভের ৫০০ মিলিয়ন ডলার হারাল বাংলাদেশ

এস আলম নিয়ন্ত্রণাধীন সময়ের ইসলামী ব্যাংকের কুকীর্তিতে ১ দিনে রিজার্ভের ৪৫০ মিলিয়ন ডলার গায়েব। এই তথ্য প্রকাশ করে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড । রিপোর্ট করেছেন: মজুমদার বাবু

১১ আগস্ট হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার কমে যায়। সেদিন রোববার আন্তর্জাতিক বন্ধের দিনেও ডলারের এ পতন ছিল বিস্ময়কর। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, দেশের রিজার্ভ আবার হ্যাকিংয়ের শিকার হলো কি না।

তবে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাওনা ডলার সরবরাহ করতে ইসলামী ব্যাংক ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ সমন্বয় করার কারণে রিজার্ভ এভাবে কমে গিয়েছিল। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও গভর্নরের উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসেরের ইসলামী ব্যাংককেন্দ্রিক কুকীর্তি ঢাকতে এ কাজ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত

পলাতক সাবেক গভর্নর রউফ তালুকদারের নির্দেশে ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই বাকিতে ডলার কেনার এ পদ্ধতি শুরু হয়। ওই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার কিনে সমপরিমাণ টাকা ব্যাংকটির অ্যাকাউন্টে জমা দেয়। তবে ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ধাপে ধাপে এ ডলার সরবরাহ করেছে অনেক পরে।


ইসলামী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই থেকে এ বছরের ৩ জুলাই পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে মোট ১.৬ বিলিয়ন ডলার কিনেছে।


চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশ ব্যাংক ৫৫০ মিলিয়ন ডলার কেনে। এসব ডলারের সমপরিমাণ টাকা ইসলামী ব্যাংককে পরিশোধ করা হলেও ব্যাংকটি ডলার সরবরাহ করেনি। প্রকৃত রিজার্ভ ৫৫০ মিলিয়ন ডলার কম হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার জন্য এ অঙ্কটিও রিজার্ভে দেখানো হয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক রিজার্ভ পরিসংখ্যান আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।


হঠাৎ রিজার্ভ সমন্বয়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকে আর আসেননি। ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।


পরে রউফ তালুকদার, তার উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসের এবং ডেপুটি গভর্নর খোরশেদ আলম সবাই পদত্যাগ করেন। এর ফলে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর নূরুন্নাহার ইসলামী ব্যাংকের পাওনা ডলার আদায়ে বিপাকে পড়েন।


কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর তিনি ইসলামী ব্যাংকের হিসাব কেটে রিজার্ভ সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নেন। ১১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার (৫,৩১০ কোটি টাকা) কেটে নেওয়া হলে রিজার্ভ প্রায় আধা বিলিয়ন ডলার কমে যায়।


বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১১ আগস্ট প্রতি ডলার ১১৮ টাকার বিনিময় হারের ভিত্তিতে বকেয়া ডলারের পরিমাণ নিষ্পত্তির জন্য পাঁচ হাজার ৩১০ কোটি টাকা কেটে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫৫০ মিলিয়ন ডলার কিনলেও ব্যাংকটি পরিশোধ করেছিল মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার।


যা বলছেন বিশ্লেষকেরা

সিনিয়র ব্যাংকার এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল আমিন টিবিএসকে বলেন, "'বকেয়া' ডলার ক্রয়ের বিপরীতে টাকা ছাড় করা ডাবল এন্ট্রি সিস্টেমের পুরোপুরি লঙ্ঘন এবং গুরুতর অপরাধ। এটা কেউ করে থাকলে তিনি রিজার্ভের হিসাবেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। যা অমার্জনীয় অপরাধ।"


বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'এমনটা ঘটে থাকলে তা জালিয়াতি নয়, রীতিমতো ডাকাতি। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।'


তিনি আরও বলেন, 'এ ঘটনার সামষ্টিক ফলাফল হচ্ছে রিজার্ভের ৫০০ মিলিয়ন ডলার হারাল বাংলাদেশ। এটা জনগণের টাকা, কারও নিজের নয়।'


রিজার্ভের তথ্য প্রকাশে অস্বাভাবিক গোপনীয়তা

রিজার্ভের তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা কাগজে-কলমে তাদের দায়িত্ব হলেও এর কোনো হিসাবই তাদের কাছে নেই। বর্তমানে এর হিসাব করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ।


অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের কাছে রিজার্ভের হিসাবায়নের দায়িত্ব হস্তান্তরের কারণ স্পষ্ট নয়। এ বিভাগটি ৯ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভের পরিসংখ্যান দিতে পারেনি।


৮ আগস্টের তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৫.৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা ১২ আগস্ট প্রায় ৪৩০ মিলিয়ন ডলার কমে হয়েছ ২৫.৪৬ বিলিয়ন ডলার।


এদিকে পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের সূত্র নিশ্চিত করেছে, ইসলামী ব্যাংকের হিসাব থেকে পাঁচ হাজার ৩১০ কোটি টাকা বিকলন করা হয়েছে, যা রিজার্ভ সমন্বয়ের বিষয়টিকে সমর্থন করে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।


রিজার্ভের সুদহারে ছাড়

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গড় সুদের হার ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, ডলারগুলো সেখানে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক এ হারে সুদ পেত।


তবে ইসলামী ব্যাংকের ডলার বকেয়া থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগ গভর্নরের নজরে আনলে তিনি প্রায় অর্ধেক (২ দশমিক ৬৫ শতাংশ) হারে সুদ নেওয়ার নির্দেশ দেন। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ সুদ আদায় করতে পেরেছে তা জানা সম্ভব হয়নি।


বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এস আলম গ্রুপ ঋণ নিয়ে আত্মসাতের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামী ব্যাংক মারাত্মক তারল্য সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। সংকট এতটাই তীব্র ছিল যে, ব্যাংকটি নগদ জমা স্থিতিও (সিআরআর) বজায় রাখতে পারেনি।


তখন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, তার উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসের ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর ছাইদুর রহমান বকেয়া ডলার বকেয়া রেখে রিজার্ভ থেকে নগদ টাকা ছাড়ের এ প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছিলেন।


ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার ক্রয় দেখিয়ে নগদ টাকার জোগান দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইসলামী ব্যাংক ধীরে ধীরে এসব ডলার পরিশোধ করত। অথচ তা রিজার্ভে প্রদর্শন করা হতো টাকা ছাড়ের দিন থেকেই। ফলে পুরো রিজার্ভের হিসাবায়নই ছিল এক প্রকার শুভঙ্করের ফাঁকি।


ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস