প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বার ২০২৪ , ০৭:৩৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন মারাত্মকভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ ধরনের পরিবর্তনের লাগাম টানতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে প্রতি বছরই জাতিসংঘের আয়োজনে জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে শুরু হওয়া জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৯ (কনফারেন্স অব পার্টিজ) এর এবারের আলোচনার মূল বিষয় হলো অর্থ। দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যেই মূলত শুরু হলো জলবায়ু সম্মেলন। এছাড়াও ২০২৫ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক ব্রাজিলসহ উল্লেখযোগ্য সব দেশই জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির আওতায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২০৩০ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। এ লক্ষ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সামলাতে ২০২৫ সাল নাগাদ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থসহায়তা দিতে রাজি হয়েছিল বড় অর্থনীতির দেশগুলো। তবে এখন পর্যন্ত সেই সহায়তার পরিমাণ সন্তোষজনক নয়। আর উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় থাকা বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণকারী চীন ও উপসাগরীয় দেশগুলো এ সহায়তা তহবিলে অর্থ দিচ্ছে না। আজারবাইজানের বাকুতে চলমান জলবায়ু সম্মেলনেও (কপ২৯) বরাবরের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেলসমৃদ্ধ ও উন্নত দেশগুলোর যে অনীহা দেখা যাচ্ছে, তাতে এবারের সম্মেলনের সফলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জলবায়ু সংকটের পাশাপাশি ইউক্রেন ও গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটও নেতাদের আলোচনার টেবিলে উঠবে। পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে কার্বন নিঃসরণ ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য শুধু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চাহিদা প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন বা ৫ লাখ কোটি ডলার। জাতিসংঘের অর্থ-সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্টে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে।
জাতিসংঘের অর্থ-সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির গত বুধবার প্রকাশিত এ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু রক্ষার স্বার্থে এশিয়ার ২০টি দেশের মোট ৩৭৪টি অবশ্য প্রয়োজনের জন্য খরচ ধার্য হয়েছে ৩ দশমিক ৩ থেকে ৪ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। এ অর্থের মধ্যে উষ্ণায়ন প্রশমন বা ‘মিটিগেশন’-এর জন্য প্রয়োজন ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার এবং অভিযোজন বা ‘অ্যাডাপটেশন’-এর জন্য দরকার ৩২৫ থেকে ৪৩১ বিলিয়ন ডলার। এ অর্থ দাবির মধ্যে সিংহভাগ ভারতের। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ১২ বিলিয়ন ডলারও এর মধ্যে ধরা হয়েছে। এ চাহিদায় ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এ রিপোর্ট এশিয়া সংক্রান্ত হলেও এর মধ্যে চীনের চাহিদার কোনো উল্লেখ করা হয়নি। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কার্বন প্রশমন ও অভিযোজনে রাষ্ট্রীয় নির্ধারিত অবদানের (এনডিসি) নিরিখে সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রয়োজন এশিয়ার। তারপর আফ্রিকার। চাহিদার ভিত্তিতে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান ও পাকিস্তান। আয়তন, জনসংখ্যা ও দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের নিরিখে বাংলাদেশও রয়েছে প্রথম দিকে। এ রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ১৪২টি দেশের মোট ৫ হাজার ৭৬০টি প্রয়োজনের মধ্যে ২ হাজার ৭৫৩টির খরচ হিসাব করা হয়েছে। এটি মোট প্রয়োজনের ৪৮ শতাংশ। এর জন্য খরচের দাবি মোটামুটিভাবে ৫ থেকে সাড়ে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। দূষণমুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে ২০৩০ সালের এই অর্থ উন্নত বিশ্বকে খরচ করতে হবে। সেই অর্থ উন্নত বিশ্ব দেবে কি না, দিলেও কতটুকু, বাকুতে ‘কপ২৯’-এর আসরে সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়। সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের অনুপস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদয় অর্থায়ন ঘিরে সংশয় তীব্র করে তুলেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এ সংক্রান্ত ঘোষণা বুঝিয়ে দেবে, বাকু সম্মেলনের সাফল্য-ব্যর্থতার মাত্রা কতখানি।
এদিকে ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি জলবায়ু ঝুঁকি চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদে সমন্বিতভাবে ‘জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা’ (ন্যাপ) গ্রহণ করেছিল সরকার। ন্যাপে বলা হয়েছে, ওই ১৪টি জলবায়ু ঝুঁকি বা দুর্যোগের হার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঝুঁকিগুলোর তীব্রতা বাড়ছে বলেই আবহাওয়ার প্যাটার্ন তথা ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিসিএডি) তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলের মানুষের ঘরবাড়ি ও জীবিকা বিপন্ন হওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১২ থেকে ১৮ শতাংশ ডুবে যাওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দুর্যোগ হলো ঘূর্ণিঝড়। ১৯৬০ থেকে ২০১০ সালে বাংলাদেশে মোট ২১টি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, যেগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৭ থেকে ১১৭ কিলোমিটারেরও বেশি। এগুলোর মধ্যে ৩৩ শতাংশ ঘূর্ণিঝড় বর্ষার আগে হয়েছিল এবং ৬৭ শতাংশ হয়েছিল বর্ষা-পরবর্তীতে। যেখানে ১৯৭১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে প্রতি দুই থেকে তিন বছরে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করত, সেখানে ২০২৩ সালে চার-চারটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা কি সম্ভব: জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। তাই ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল, বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখা। সেজন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত যেন কাগজে-কলমেই রয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ গত বছর আরব আমিরাতে কপ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়ে একটা ঐকমত্য হয়েছিল। কিন্তু এর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, চলতি বছর জি২০ সম্মেলনে কিছু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে দাঁড়ানোর আভাস দিয়েছে। আর সম্প্রতি কলম্বিয়ায় জাতিসংঘের পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক আলোচনাও কোনো ঐকমত্য ছাড়া শেষ হয়। জ্বালানি তেলের রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ তো দূরের কথা, কমানোরও ঘোরবিরোধী। কারণ তাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে তেল-গ্যাস। ওপেক সদস্যভুক্ত দেশগুলোর কথা হচ্ছে, জলবায়ু সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করা না করা নয়, বরং দূষণ কমিয়ে আনায় অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। ওপেকের সদস্য দেশ সৌদি আরব। রাশিয়া ওপেক প্লাস জোটের প্রভাবশালী সদস্য। দেশ দুটির মিলিত প্রচেষ্টায় ওপেকের অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জ্বালানি তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণে সৌদি আরব ও রাশিয়ার প্রভাব রয়েছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, গতবারের কপ আয়োজক সংযুক্ত আরব আমিরাত, এবারের আয়োজক আজারবাইজান এবং ২০২৫ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক ব্রাজিলসহ উল্লেখযোগ্য সব দেশই জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। অর্থাৎ যারা আয়োজক দেশ তারাই এ স্ববিরোধী আচরণ করছে। একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রেও। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এবারের কপ সম্মেলনে কয়েকটি বড় অর্থনীতি এবং সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উপস্থিত থাকছেন না। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাদের অনুপস্থিতি এ সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক কমিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর জলবায়ু নিয়ে নানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানিকে তিনি বরাবরই একটি ‘প্রতারণা’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্যারিস চুক্তি থেকেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিতে চান। ফলে জলবায়ু সহায়তা তহবিলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সার্বিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা বা কমানোর বিষয়টি মারাত্মকভাবে হোঁচট খেতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।