ঢাকা অফিস

প্রকাশিত: ২১ এপ্রিল ২০২৫ , ০৩:০৬ এ এম

অনলাইন সংস্করণ

ঋণের নামে ১০ প্রতিষ্ঠান ৪ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে পাচার করেছে

আশরাফুল ইসলাম : দেশ থেকে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে আলোচিত ১০ প্রতিষ্ঠান দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছে ৪ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খেকো এস আলমই হাতিয়ে নিয়েছেন সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। আর আরেক ব্যাংক খেকো সালমান এফ রহমান নিয়েছেন ৫৩ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যাংক থেকে টাকা লুটের তথ্য আরো বাড়তে পারে। এসব অর্থের বেশির ভাগ অংশই পাচার করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যামেলকো অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক সূত্র জানিয়েছে, আলোচিত ১০টি কোম্পানি সুকৌশলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে টাকা বের করে নিলেও তা দেশে বিনিয়োগ না করে বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার করে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে দেশী-বিদেশী একাধিক সংস্থা পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাচারকৃত অর্থের গন্তব্য চিহ্নিত করা হয়েছে।

বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, আলবেনিয়া, সাইপ্রাস, স্লোভাকিয়া, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, ডোমেনিকা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইমান আইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ব্যাংক খেকো এস আলম। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বোন রেহেনাসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে এস আলম ছিলেন অতি আপনজন। দেশের ব্যাংক খাত খালি করে তাদের অর্থের জোগান দেয়া হতো। পাশাপাশি নিজেও হাতিয়ে নিয়েছেন জনগণের অর্থ। একপর্যায়ে শেখ পরিবারের সবচেয়ে নির্ভরশীল অর্থের জোগানদাতা হয়ে ওঠেন ব্যাংক ডাকাত এস আলম। আর এ কারণে একে একে দেশের প্রতিষ্ঠিত আটটি ব্যাংক এস আলমের একক মালিকানায় দিয়ে দেয়া হয়।

এজন্য রাতের অন্ধকারে একটি গোয়েন্দা সংস্থ্রা সদস্যদেরকে দিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত মালিকদের বন্দুকের ডগার মুখে ব্যাংক হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংককে মাত্র এক দিনের মধ্যে তৎকালীন এমডি ও চেয়ারম্যানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ধরে নিয়ে ব্যাংক হস্তান্তর কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।

ইসলামী ব্যাংক দখলে নিয়েই ব্যাংকটি থেকে পানির মতো অর্থ বের করে নিয়ে যান সাইফুল আলম। এভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকসহ আটটি ব্যাংক দখলে নেন এস আলম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিতে সরাসরি সহযোগিতা করে এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিনসহ প্রায় ডজন খানেক কর্মকর্তা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। যেখানে টাকা লুটের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অনেকটা নিরুপায় হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে এস আলম হাতিয়ে নিয়েছেন ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে থাকা তার সব সম্পদ ইতোমধ্যে বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ব্যাংকগুলো পর্ষদ ভেঙে দিয়ে স্বতন্ত্র পরিচালক দ্বারা ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে। লুটপাটের শিকার হয়ে ব্যাংকগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাদে এখন গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না অন্য ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে আরেক ব্যাংক খেকো সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে অর্থ বের করে নিয়ে নিয়েছেন ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এটাও প্রাথমিক হিসাব। প্রকৃত হিসাবে আরো ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তদন্ত সংস্থাগুলো। এস আলম ও সালমান এফ রহমানের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক এখন রুগ্ণ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের প্রাথমিকভাবে দেশ থেকে টাকা পাচারের তালিকার মধ্যে অন্যআটটি প্রতিষ্ঠারের মধ্যে রয়েছে নাসা গ্রুপ।

গ্রুপটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কিছুদিন পরপর নানা অজুহাতে ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা তুলে শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে সরবরাহ করতেন এই নজরুল ইসলাম মজুমদার। বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডিদের ব্যাংকের পে অর্ডার নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিতরণ করতেন। তিনি নিজেও সফেদ পাঞ্জাবি পড়ে ছবি তুলে ব্যাংকের অর্থে তা আবার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপাতেন। বিশেষ করে আওয়ামী অনুগত মিডিয়াগুলোতে বড় আকারে এসব ছবি ডিসপ্লে করতেন। আর এ সুবাদে তিনি এক্সিম ব্যাংকে অনেকটা আজীবনের জন্য চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। দখল করে ছিলেন ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যানের পদটিও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে নজরুল ইসলাম মজুমদার দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে নামে-বেনামে অর্থ বের করে নিয়েছেন ২১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।

এসব অর্থের বড় একটি অংশ পাচারের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ প্রায় আটটি দেশে নজরুল ইসলাম মজুমদারের অর্থ পাচারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব অর্থ শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিকদার গ্রুপ ৬ হাজার কোটি টাকা, সামিট গ্রুপের নামে ৭ হাজার কোটি টাকা, বসুন্ধারা জেমকন গ্রুপের নামে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান বাবুর কোম্পানি আরামিট গ্রপের নামে ৮০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে পাচারের তালিকায় ওরিয়ন গ্রুপ ও নাবিল গ্রুপেরও নাম রয়েছে।