প্রকাশিত: ২৮ মার্চ ২০২৫ , ০৬:৩৮ এ এম
অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ ড্র করে ভারতীয় স্প্যানিশ কোচ খেলা শেষে বলেছিলেন, 'আমরা সব মিলিয়ে অনটার্গেটে মাত্র দুইটা শট করতে পেরেছিলাম। ফিফার ১৮৫ নম্বর র্যাংকিংয়ে থাকা দেশটি যেভাবে আমাদের ওপর চড়াও হয়ে খেলেছে এবং যেভাবে গোলের সুযোগ তৈরি করেছে, তাতে বলতে হয় খেলার ইতিবাচত দিক হচ্ছে আমরা একটা গোলও খাইনি।'
ভারতীয় ফুটবল গেল কয়েক মাস ধরেই খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে জামালদের বিপক্ষে ম্যাচের আগে বেশ সতর্ক ছিলেন তারা। গোলের খরা কাটাতে অবসরে যাওয়া সুনীল ছেত্রীকে এনেছিলেন ভারতীয় দলের স্প্যানিশ কোচ মানোলো মার্কেজ। দেশের স্বার্থে তাকে ফিরতে হয়েছিল। আর অন্যরা দেখল সুনীলকে ফেরানো মানে ভারতীয় ফুটবল পেছাচ্ছে। সুনীল পুরো ৯০ মিনিট খেলতে পারেননি। আর যতটুক সময় খেলেছেন, ততটুকুতেও বাংলাদেশের ওপর কিছুই করতে পারেননি। অথচ বাংলাদেশে হামজা চৌধুরী খেললেন পুরো ম্যাচ। নিজে খেলেছেন, দলকে খেলিয়েছেন। মাঠে দুই দলের ২২ ফুটবলারের মধ্যে হামজা ছিলেন আলাদা। যারা হামজাকে দেখেছেন, তারা এখনো তার অসাধারণ নৈপুণ্য নিয়ে কথা বলছেন। চোখে লাগার মতো ফুটবল খেলেছেন। কখনো রক্ষণে বাংলাদেশের গোল লাইনে দাঁড়িয়েছেন। কখনো মধ্যমাঠে গিয়ে বল বাড়িয়েছেন, বিপজ্জনক কর্নারগুলো করেছেন। রহমত মিয়াকে ডজ দিয়ে উইংয়ের লাইন ধরে ভারতীয় ফুটবলার লিস্টন কোলাস ঢুকে পড়ছিলেন বাংলাদেশের সীমানায়। দূর থেকে দৌড়ে এসে বল কেড়ে নিয়েছেন হামজা। হামজা শুধু বাংলাদেশের ফুটবল দর্শকের মন ভরিয়ে দেননি, ভরিয়ে দিয়েছেন ভারতের দর্শকদের। এমনকি নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, সিংগাপুর, হংকংয়ের দর্শকদেরও।
গেল ১৭ মার্চ হামজা বাংলাদেশে এসেছিলেন। আসার পর থেকে একটি দিনের জন্য বিশ্রাম ছিল না। তাকে দেখার জন্য ভক্তদের ভিড়, ছবি তোলা, ছুঁয়ে দেখার আকুতি। আর এসবে এক মুহূর্তের জন্যও বিরক্ত না হয়ে সবার আকুতি মিটিয়েছেন তিনি। ক্লান্তিহীন যোদ্ধা তিনি। কয়েক সেকেন্ডের জন্যও তার মুখ থেকে হাসি সরেনি। হাজার হাজার মানুষের আবদার মিটিয়েছেন। ধনী পরিবার থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত যারাই হামজার কাছ পর্যন্ত গিয়েছেন, তারাই হামজার দেখা পেয়েছেন। হাসিমুখে হামজা সবাইকে বরণ করে নিয়েছেন। অসাধারণ একজন মানুষ। কোনো অহংকার নেই। ফুটবল খেলার বাইরেও যে তিনি আরো বড় একজন মানুষ, তা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। সার্বক্ষণিক তার মুখে হাসি লেগেই ছিল। ইংলিশ লিগে খেলা এত বড় মাপের একজন ফুটবলার বাংলাদেশে ১০ দিনের সফরে ছিলেন। তার কথায়, চাল-চলনে, আচার-আচরণে মনে হয়েছে তিনি অসাধারণ এবং অমায়িক একজন মানুষ। বাংলাদেশের অনেক সাবেক ফুটবলার বলেছেন, 'আমাদের দেশের কোনো খেলোয়াড় হলে তার পা মাটিতে পড়ত না। কথাই বলা যেত না। হামজার মধ্যে সেরকম কিছুই দেখা যায়নি।' জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকার সময় সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছেন। নিজে থাকতে পারতেন বড় কোনো হোটেলে। কিন্তু সেটা করেননি। ভারতের শিলংয়ে হামজার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানরা ছিলেন, কিন্তু টিম হোটেলের বাইরে। অন্য হোটেলে। ভারতের বিপক্ষে ড্র হওয়া ম্যাচের রাতে হোটেলে গিয়েছিলেন বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করতে।
হামজার আগমনে বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন বাতাবরণ শুরু হয়েছে। নিন্দুকেরা বলাবলি করতেন, হামজা কী করবে। ভারতও কটাক্ষ করেছিল হামজাকে নিয়ে। তারা বলেছিল, লাফালাফি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে হামজার বঝলকে পুড়ে ছাই হয়েছেন সমালোচকরা। একজন হামজাই ভারত-বাংলাদেশের ফুটবলকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি কোন মানের খেলোয়াড়। মানুষ হিসেবেও তিনি বাংলাদেশের কাছে আলাদা করে পায়ের চিহ্ন রেখে লন্ডনে ফিরে গেছেন। হামজাকে নিয়ে দেশের ফুটবল দর্শকরা এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখেন। হামজার আগমনে দেশের ফুটবলে আশার বাতি জ্বলেছে। সবাই খোঁজ নিচ্ছেন এশিয়ান কাপে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচ কোথায় হবে। বাংলাদেশ ফুটবল দলের জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন হামজা। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা জেতাতে পারেননি। মুখে না বললেও আফসোস থাকাটাই স্বাভাবিক। আবার যখন আসবেন, নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আসবেন। মাঠে আর মাঠের বাইরে ঝড় তোলা হামজা লন্ডনে ফিরে গেছেন। পেছনে রেখে গেছেন হাজারও স্মৃতি।