তপন চক্রবর্তী

ব্রিটিশ আমলে মিয়ানমার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তাতে বাধা হিসেবে দাঁড়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ওই বিশ্বযুদ্ধের আগে বাংলাদেশের অনেক মানুষ জীবিকার সন্ধানে দেশটিতে যাতায়াত করতেন।

তখন থেকেই দেশটির সঙ্গে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।
চট্টগ্রামের সঙ্গে মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দরের রেল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ১৮৯০ সালে রামু ও কক্সবাজার হয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮-০৯ সালে সমীক্ষাও চালানো হয়। ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত আবারও সমীক্ষা চালানো হয়। এরপর শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় বাকি কাজ।

বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সরকার সেই রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) এ পথে ট্রাফিক সম্ভাবনা সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা আর এগোয়নি।

ভারত ছাড়া একমাত্র মিয়ানমারের সঙ্গেই বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সীমান্ত ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যোগাযোগের জন্য স্থলপথে মিয়ানমারকেই বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সরকারের আহ্বানে ১৯৭৬-৭৭ সালে আবারও সমীক্ষা চালায় জেআরটিএস। ১৯৯২ সালে এসকাপ (এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন) অধিবেশনে তিনটি ইউরো-এশিয়া রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর একটি রুট ছিল বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত।

২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে আবারও এই রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রের তথ্য, ২০১০ সালে এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকার প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই প্রকল্পে সিঙ্গেল লাইন মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু ট্রান্স এশীয় রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হতে ব্রডগেজ রেলপথ লাগবে। তাই প্রকল্প সংশোধন করে ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল পাস করা হয়।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী থেকে কক্সবাজার সদর পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও তার আগে চলতি বছরের ডিসেম্বরের দিকে পুরোপুরি কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু হয়ে পাহাড় ও নদীপথ দিয়ে পর্যটননগর কক্সবাজার পর্যন্ত এই রেললাইন চলে গেছে। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এই রেললাইন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার। প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে এশিয়ান ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকার। এটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতাভুক্ত।

শনিবার (১১ নভেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রেললাইন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ১ ডিসেম্বর থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে ৪১ বছরের বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর ফলে এক লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মিয়ানমারের জলসীমাও চিহ্নিত হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীনে যোগাযোগ তৈরি হলে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

কক্সবাজার সৈকত পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হওয়ায় বিনিয়োগ বাড়বে পর্যটন, কৃষি ও চিংড়ি শিল্পে। জেলায় উৎপাদিত পণ্য কম মূল্যে যেমন পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনি পর্যটক আগমনও বাড়বে। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও গতি আনবে নতুন এই রেলপথ।

১৩২ বছর পর চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যে রেলপথের জন্ম হয়েছে, সেই রেলপথ নিয়ে এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, এলাকাবাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করছেন।