ভারতীয় উপমহাদেশে এমন সঙ্গীতপ্রেমিক পাওয়া যাবে না, যিনি কবি ও গীতিকার গুলজারের নাম এবং তাঁর লেখা গান শোনেননি। তাঁর অন্য সব গান বাদ দিলেও “চল ছাইয়া ছাইয়া, চল ছাইয়া ছাইয়া -” গানটির জন্য সঙ্গীতপ্রেমিকরা তাঁকে স্মরণ করবে। ২০০২ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক আন্তর্জাতিক জরিপে সকল সময়ের ১০টি জনপ্রিয় গানের মধ্যে এই গান নবম অবস্থানে ছিল। ১৯৯৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবিতে একটি ট্রেনের ওপর চিত্রায়িত গানে শাহরুখ খান ও মালাইকা অরোরা’র নৃত্য দৃশ্য অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু লাগলেও গানের কথাগুলো উপলদ্ধি করার পর তারাও নৃত্যের অমার্জিত অংশটুকু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আমার বিশ্বাস। এটি মূলত একটি আধ্যাত্মিক গান এবং পাঞ্জাবের বিখ্যাত সুফি কবি বুল্লে শাহের (১৬৮০-১৭৫৮) “তেরে ইশক নাচাইয়া করকে থাইয়া থাইয়া/তেরে ইশক নে ডেরা মেরে আন্দার কীতা/ভর কে জেহের পেয়ালা মে ম্যায় তান আ’পে পীতা/ঝাবদে ওয়াহুদি তবিবা নাহি তে ম্যায় মর গাইয়াঁ” (তোমার প্রেম আমাকে সর্বত্র নাচতে বাধ্য করছে/তোমার প্রেমে পড়া ছিল আমার জন্য পাত্রভর্তি বিষ পানের মত/এসো আমার নিরাময়কারী, এখন আমার শেষ সময়।) কবিতা থেকে তাঁর “চল ছাইয়া ছাইয়া’র অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।

গুলজারের পুরো নাম সমপুরান সিং কালরা। ১৯৩৪ সালে তিনি বর্তমান পাকিস্তানের ঝিলাম জিলায় দীন এলাকার এক শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এলাকার ‘দীন’ নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি তাঁর কবি নাম পছন্দ করেন “গুলজার দীনভি,” যদিও তিনি শুধু ‘গুলজার’ নামেই অধিক খ্যাত। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের সময় তাঁর পরিবারও বিভক্ত হয়ে যায়, তাঁকে পড়াশোনা বন্ধ রাখতে হয় এবং পরিবারকে সহায়তা করার জন্য তিনি মুম্বাই আসেন। নিজের ও পরিবারের জীবিকা সংস্থানের জন্য তাঁকে একটি গ্যারেজে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ গাড়ি মেরামত ও গাড়ি রঙ করাসহ অনেক ছোটখাট কাজ করতে হয়েছে। স্কুলে পড়ার সময় তিনি ক্লাসে পাঠ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার অনুবাদ পড়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। ছাত্র জীবনেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং তরুণ বয়সেই তাঁর লেখক-কবি হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করায় পিতার কাছে তিরস্কৃত হন। তিনি বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং বামপন্থী লেখক কবিদের সংগঠন ‘প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

গীতিকার হিসেবে তাঁর জীবন শুরু হয় ১৯৬৩ সালে সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে। পরবতীতে তিনি আরও ক’জন খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেন এবং এক পর্যায়ে তিনি নিজেও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে খ্যাতির অধিকারী হন। ১৯৭৩ সালে গুলজার বলিউডের বিশিষ্ট বাঙালি অভিনেত্রী রাখীকেবিয়ে করেন, কিন্তু দু:খজনকভাবে তাদের দাম্পত্য জীবন মাত্র এক বছর স্থায়ী ছিল। ইতোমধ্যে তাদের কন্যা মেঘনা গুলজারের জন্ম হয়েছিল। তাদের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি, কিন্তু তারা পৃথক থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তবে কন্যা মেঘনা যৌথভাবে লালনপালন করেছেন। কন্যা বয়সী মেঘনা গুলজার “বিকজ হি ইজ” নামে তার পিতার জীবনী লিখেছেন, এবং এটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গুলজার বলেছে যে সাড়ে চার দশকের অধিক সময় যাবত রাখী এবং তিনি বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করলেও তারা দু’জন কখনও পৃথক হতে পারেননি। তিনি বলেন, “এমনকি এখনও আমি তাঁর রান্না করা মাছ খেতে চাইলে প্রথমে তাঁকে একটি শাড়ি ঘুষ দেই, যেভাবে আমি আমাদের প্রেম করার সময়ে তাঁকে দিতাম। আমাদের প্রণয়ের দিনগুলোতে আমি তাঁকে এত বেশি শাড়ি দিয়েছি যে আমি চমৎকার ঢাকাই শাড়ি ও তাঁতের শাড়ি চিনতে শিখেছিলাম। আমি তাঁকে সেরা শাড়ি দিতাম এবং এখনও দেই।” তিনি আরও বলেছেন, “আমরা সবসময় একত্রে ছিলাম — মতের অমিল, কলহ করা ও আনন্দময় মুহূর্তে। এটি যদি একত্রে থাকা না হয়, তাহলে আমি জানি না যে এটি কী!”

গুলজার তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে ভারতের তৃতীয় শীর্ষ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘পদ্মভূষণ’, ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ লাভ করেছেন। এছাড়া তিনি ২২ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, পাঁচটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এ আর রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে গ্র্যামি এওয়ার্ড লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।

কবি ও গীতিকার ছাড়াও তাঁর বেশ কিছু সাহিত্যকর্ম রয়েছে। তিনি মির্জা গালিবের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত এবং মির্জা গালিবের জীবনের ওপর তাঁর রচিত “মির্জা গালিব: অ্যা বায়োগ্রাফিক্যাল সিনারিও” (এবং বইটি আমি অনুবাদ করেছি এবং আহমদ পাবলিশিং হাউজ সেটি প্রকাশ করেছে) অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় একটি বই, যার ওপর ভিত্তি করে গুলজারের পরিচালনায় নাসিরুদ্দিন শাহ অভিনীত টিভি সিরিয়াল ‘মির্জা গালিব’ এক অনন্য সৃষ্টি, যা মির্জা গালিবকে উপমহাদেশের ঘরে ঘরে পৌছে দিয়েছে।

গুলজারের যে গানের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম, পাঠকদের কাছে পুরো গান বাংলা অনুবাদসহ উপস্থাপন করছি:
“জিনকে সর হো ইশক কী ছা’ওঁ
পা’ও কে নিচে জান্নাত হোগি,
সর ইশক কী ছা’ওঁ চল ছাইয়া ছাইয়া,
ওহ ইয়ার হ্যায় জো খুশবু কী তরহ,
জিসকি জুবান উর্দু কী তরহ,
মেরি শাম রাত, মেরি কায়েনাত,
ওহ ইয়ার মেরা সাইঁয়া সাইঁয়া।
গুলপোষ কভি ইতরায়ে কাহি,
মেহকে তো নজর আ’জায়ে কাহি,
তাবিজ বানাকে পেহনু উসে,
আয়াত কী তরহ মিল জায়ে কাহি,
ওহ ইয়ার হ্যায় জো ইমান কী তরহ
মেরা নাগমা ওহি মেরা কলমা ওহি,
মেরা নাগমা নাগমা মেরা কলমা কলমা।
ইয়ার মিসাল-এ-ওস চলে
পাও কে তলে ফিরদৌস চলে
কভি ডাল ডাল কভি পাত পাত,
ম্যায় হাওয়া পে ডুন্ডু উসেেক নিশান
সর ইশক কী চাও চল ছাইয়া ছাইয়া।
ম্যায় উসকে রূপ কা শাইদা’য়ী,
ওহ ধুপ ছাও সা হরজায়ী
ওহ শোখ হ্যায়, রঙ বদলতা হ্যায়
ম্যায় রঙ-রূপ কা সউদায়ী,
চল ছাইয়া ছাইয় চল ছাইয়া ছাইয়া।”

বাংলা অনুবাদ
যার মাথা প্রেমের ছায়ার নিচে,
তার পায়ের নিচে আছে বেহেশত,
প্রেমের ছায়ায় মাথা রেখে ছায়ায় ছায়ায় চলো
যে বন্ধু সুগন্ধির মতো, যার ভাষা উর্দুর মতো,
যে আমার দিন ও রাত, যে আমার কাছে সমগ্র বিশ্ব।
সে ফুলে ফুলে ঢাকা, তার জাদুর সুবাস শুধু আমি জানি,
আমার কাছে সে কোরআনের পবিত্র আয়াত
তাকে পেলে আমি তাবিজের মত ধারণ করি।
সে আমার ইমান, আমার গান, আমার কালিমা।
আমার প্রেমিক শিশির বিন্দুর মত পা ফেলে,
চলার সময় তার পায়ে নিচে জান্নাতুল ফিরদাউস।
আমি সর্বত্র তাকে খুঁজি, বাতাসে তার চিহ্ন খুঁজি।
আমি তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করি,
সে রোদ এবং ছায়ার মত অবর্ণনীয়।
সে এক প্রাণবন্ত যে সবসময় রঙ বদলায়,
আমি তার রঙ ও সৌন্দর্য নিয়ে থাকি।
ছায়ায় ছায়ায় চলো, ছায়ায় ছায়ায় চলো —–

গুলজারের কবিতা উর্দু-হিন্দি কাব্যপ্রেমিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর একটি কবিতা:

“মেরি খাতা তো সাবিত কর,
জো বুরা হু তো বুরা তো সাবিত কর,
তুমহে চাহা হ্যায় কিতনা তু জা জানে,
চল ম্যায় বেওয়াফা হি সহি তু আপনা ওয়াফা তো সাবিত কর।”

(আমার অপরাধ কী তা প্রমাণ করো,
আমি যে মন্দ সেই মন্দটুকু প্রমাণ করো!
তোমাকে কতটা চেয়েছি তা তুমি জানো,
আমি না হয় অবিশ্বাসী, তুমি যে বিশ্বাসী প্রমাণ করো।)
“তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোঈ শিকওয়া তো নেহি,
তেরে বিনা জিন্দেহি ভী লেকিন জিন্দেগি তো নেহি।”
(তোমাকে ছাড়া জীবনের কাছে তো কোনো অভিযোগ নেই,
তোমাকে ছাড়া যে জীবন সেটি তো কোনো জীবন নয়।)
“কৌন কেহতা হ্যায় হাম ঝুট নেহি বোলতে,
এক বার দেখিয়ে পুছ কর তো দেখিয়ে।”
(কে বলে যে আমি মিথ্যা বলি না,
এক বার প্রশ্ন করে তো দেখো।)