ফিলিস্তিনে ইসরাইলি নৃশংসতার খবর বরাবরই সংবাদমাধ্যমকে ব্যস্ত রাখে। পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদ করতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় অবৈধ দেশটিকে। দিন যাচ্ছে আর পশ্চিম তীরে বাড়ছে ইসরাইলিদের অবৈধ বসতি। ভিটেমাটি হারিয়ে অন্য দেশে শরণার্থী জীবন বেছে নিতে হচ্ছে পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের। ফিলিস্তিনের ভূমি ও মুসলমানদের নিয়ে ইসরাইলের চতুরতার শেষ নেই। মুসলিম শিশুদেরকে ইউরোপে খৃস্টান পরিবারের কাছে পাচার করার অভিযোগও রয়েছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে।

মিশর থেকে মুসলিম শিশুদের নিয়ে ইউরোপে খৃস্টান পরিবারের কাছে পালক দিয়েছে ইসরাইল। কয়েকমাস আগে আরাবি পোস্ট এ খবর পরিবেশন করেছে। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে একটি তদন্তের প্রেক্ষিতে এ তথ্য প্রকাশ পায়।

ঘটনাটা সত্তরের দশকের। তখন সিনাই উপদ্বীপের দখল ছিলো ইসরাইলের। উপদ্বীপের এল-আরিশ শহরে পরিচয়হীন তিন শিশুকে পাওয়া যায়। ওই সময় এদেরকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেওয়া হয়। পরে সিনাইয়ের দখলে থাকা ইসরাইলের সামরিক সরকার ও দেশটির কল্যাণমন্ত্রী ওই তিন শিশুকে ইউরোপের খৃস্টান পরিবারের কাছে দত্তক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টি নিয়ে ইসরাইলের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে। তারা দত্তক দেওয়ার এই প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে জানিয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে নতুন করে তদন্তের সময় এসব তথ্য প্রকাশ পায়। ইসরাইলের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের ভিন্ন একটি তদন্তে দেখা গেছে, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া এক শিশুকেও একইভাবে পাচার করা হয়েছে। তবে ওই শিশুকে ইউরোপের খৃস্টান পরিবারে দত্তক দেওয়ার ব্যাপারে তার মায়ের লিখিত অনুমতি ছিলো।

১৯৭০ সালে আরো দুই মিসরিয় শিশুকে ইউরোপে দত্তক দেওয়া হয়েছিলো বলে নতুন করে প্রকাশিত সরকারি এক নথি থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আরো দুই শিশুকে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া করা হচ্ছিলো বলে ওই নথিতে প্রমাণ রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ইসরাইলের ডেপুটি অব স্ট্যাট কম্পট্রোলার শ্যামুয়েল হল্যান্ডার বলেন, ‘শিশুদের ওপর এমন আচরণ নৈতিকতাবিরোধী। ইউরোপের মুসলিম পরিবারের শিশুদেরকে খৃস্টান পরিবারের কাছে তুলে দেওয়া সিনাইয়ের স্থানীয় আইনের পাশাপাশি এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।’ তিনি এ বিষয়ে জেনেভা কনভেনশন এবং অন্যান্য চুক্তির উদ্বৃতিও দেন।
আরাবি পোস্টের সংবাদে এসব তথ্যই পরিবেশন করা হয়েছে। এই সংবাদ থেকে অন্তত এটা আন্দাজ করা যায় মিসর এবং ইসরাইলে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে। সেইসঙ্গে বিশ্ব বিবেকের কাছে উঁকি দিয়েছে আরো একটি প্রশ্ন- ইসরাইল কেন এই কাজটি করছে?

এই প্রশ্নের জবাব কী হতে পারে?
জবাব খুঁজার আগে চলুন ঘুরে আসা যাক অন্য আরেকটি খবর থেকে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত ওই খবরে জানানো হয়েছিলো সিরিয়া থেকে অনাথ শিশুদের পালক নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ইসরাইল। ওই সময় দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরেহ দেরি সিরিয়া থেকে প্রায় একশো শিশুকে ইসরাইলে নেওয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। ইসরাইল জানিয়েছিলো, যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই দেশটিতে অনেক শিশু পরিবারহারা হয়েছে। অনেক শিশুর বাবা ও মা মারা গেছেন। তারা শরণার্থী শিবিরে আছে আশ্রয়হীন। ইসরাইল এদের আশ্রয় দিতে চায়। ওই শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য তারা উষ্ণ বাড়ি তৈরি করে দেবে। এদেরকে আরব-ইসরাইলি পরিবারের সাথে রাখা হবে।

এই সংবাদটি শিশুদের প্রতি ইসরাইলিদের নরম মানসিকতাই প্রকাশ করছে। সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের শিশুদেরকে তারা মানবেতর অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে চাইছে।

অথচ ইসরাইলের আগ্রাসি ভ’মিকার কারণে ফিলিস্তিন রক্তাক্ত। এদের বেপরোয়া আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে অনেক শিশুর। পশ্চিম তীরের অনেক শিশু বাবা ও মাকে হারিয়ে একা আছে অন্য কোনো দেশের শরণার্থী শিবিরে।

আবার অনেক শিশুকেও বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে ইসরাইলি কারাগারে। এদের কেউ মুক্তি পাচ্ছে। কেউ পায়নি। যারা পায়নি, তারা এখন কোথায় আছে?
আর পশ্চিম তীর থেকে যেসব শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে, তারাই বা যাচ্ছে কোথায়?
২০১৯ সালে প্রকাশ পাওয়া একটি সংবাদে জানানো হয়, ইসরাইল স্বীকার করেছে যে, ফিলিস্তিনী বংশোদ্ভূত কয়েক ডজন মুসলিম শিশুকে ইউরোপের দেশগুলোতে দত্তক দিয়েছে তারা। বিশেষ করে গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে এই কাজটি ব্যাপকহারে হয়েছে। অথচ ইসরাইলের আইনেই এটি অপরাধ। তবে কিছু বাস্তবতা গোপন করে তারা এই কাজটি করেছে বলে জানায় সংবাদমাধ্যম।

ইসরাইলে বিষয়টি নিয়ে মামলা চলছিলো। দেশটির সর্বোচ্চ শরিয়া আপিল আদালতের প্রধান হিসেবে বহুবছর কাজ করেছেন আহমেদ নাটুর। তিনি ১৯৯৮ সালে তথ্য পেয়েছিলেন, ফিলিস্তিনী মুসলিমদেরকে ইউরোপের দেশ সুইডেন এবং নেদারল্যান্ডসে খৃস্টান পরিবারের কাছে পালক দেওয়া হচ্ছে।

আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিচারক নাটু বলেন, ‘ইসরাইল নিয়মিতই এই কাজটি করছে।’

নাটুর জানিয়েছেন, ইসরাইলের সর্বোচ্চ ইসলামী সংস্থার পক্ষ থেকে ১৯৯৮ সালে তখনকার সরকারের বিচারিক অ্যার্নির কাছে একটি অফিসিয়াল চিঠি পাঠানো হয়েছিলো। তবে ওই চিঠির জবাবে এর ঠিকমতো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি সরকার।
ইসরাইল কি এখনো ফিলিস্তিনী শিশুদের পাচার করছে?

আল জাজিরার এমন প্রশ্নের জবাবে নাটুর বিষয়টিকে অস্বীকার করেননি। যেহেতু ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে ২২ মুসলিম শিশুকে সুইডেনে পালক হিসেবে পাঠানোর বিষয়টি পরিষ্কার, সেহেতু এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা অস্বাভাবিক নয়।

তিনি জানিয়েছেন, ইসরাইল আনুষ্ঠানিকভাবে ২১৪ ফিলিস্তিনী শিশুকে ইউরোপ পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে। এসব শিশুদের নেওয়া হয়েছে পশ্চিম তীর, জেরুজালেম এবং গাজা উপত্যকা থেকে। এমনকি ফিলিস্তিনের বাইরে মুসলিম দেশগুলো থেকেও শিশুদের অপহরণ করার বিষয়টি উড়িয়ে দেননি তিনি।

তখনকার সাক্ষাৎকারে ইসরাইলি মুসলিম বিচারক নাটোর ফিলিস্তিনীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। ইউরোপে পাঠানো ফিলিস্তিনী শিশুদের তালিকা প্রকাশ করতে ইসরাইলকে বাধ্য করার আহ্বানও জানান তিনি।

তিনি উল্লেখ করেন, যাদেরকে ইউরোপে পাঠানো হয়েছে, তাদের বয়স এখনো ত্রিশের মধ্যে আছে।

অন্য একটি প্রতিবেদনে জানানো হয় ইসরাইলে আরব নেসেট সদস্য আহমদ টিবি এ বিষয়ে দেশটির সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ওই শিশুরা ইসলাম থেকে খৃস্টান বা ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। আর এই দর্মান্তরের জন্য সরকার এবং বিভিন্ন ইসরাইলি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেছেন তিনি।

তার এই দাবির পক্ষে জায়নিস্ট আর্কাইভে পাওয়া কিছু তথ্যের বরাতও দেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনে। এতে জানানো হয় ইয়েমেন থেকে হারিয়ে যাওয়া অনেক শিশুকে পরে খুঁজে পাওয়া গেছে ইউরোপে। এদের খোঁজ পাওয়ার সূত্র ঘেঁটে জানা গেছে, ইয়েমেন থেকে ইসরাইলি অভিবাসী শিবিরে এই শিশুরা আশ্রয় নিয়েছিলো। পরে এদের পরিবারের কোনো সন্ধ্যান পাওয়া যাচ্ছে না, এমন তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয় ইসরাইলি নথিতে। এসব তথ্যের ভিত্তিতেই তাদেরকে অন্য দেশে পালক দেওয়া হয়। আর শিশুরা মুসলিম থেকে পরিবর্তিত হয়ে যায় খৃস্টান।

ইয়েমেন থেকে শিশু হারিয়ে যাওয়ার একটি তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এক ঘটনা-
একজন মা তার চার বছরের শিশুর সাথে দেখা করতে চাইছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে ওই শিশুর আশ্রয় হয়েছিলো ইসরাইলি অভিবাসী শিবিরে। তবে শুরুর দিকে ইসরাইলের পক্ষ থেকে ওই মাকে জানানো হয়েছিলো ইসরাইলি শিবিরে এমন কোনো শিশু নেই। পরে তিনি জোর দাবি জানালে এমন এক শিশুর খোঁজ পাওয়া যায়। তবে সেই শিশুটিকে ততদিনে ইউরোপের একটি দেশে পালক দিয়ে দেওয়া হয়েছে। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ইসরাইলে যাওয়ার পর শিশুটির নামও পাল্টে ফেলা হয়েছে। তার পারিবারিক ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছিলো, তার মা ও বাবার কেউ বেঁচে নেই। আর এসব তথ্য দেখেই শিশুটিকে পালক নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো।

ইসরাইলের আইন বলছে, এ ধরণের কাজ অবৈধ। অথচ ইসরাইল শিশুদের পাচার করেছে, এই তথ্যটিও সঠিক। ফিলিস্তিন, মিশর কিম্বা ইয়েমেনের মুসলিম শিশুরা ইসরাইল থেকে ইউরোপ যাচ্ছে। এরা বড় হচ্ছে খৃস্টান অভিবাবকের তত্ত¡াবধানে। এদের পরিচয়ও হচ্ছে খৃস্টান।

ওইসব শিশুরা এখন বড় হয়েছে। আছে ইরোপের দেশেই। তবে কেমন আছে, কী করছে এসব তথ্য জানা যায়নি। হয়তো নথির সূত্র ধরে কোনো একদিন জানা যেতেও পারে। তখনি বিষয়টি স্পষ্ট হবে, ইসরাইল কেন মুসলিম শিশুদের পাচার করছে খৃস্টান পরিবারে।

আপাতত এই প্রশ্নটা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা যেতে পারে।