সাহির লুুধিয়ানভি’র গানের সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর নাম শোনার আগে এবং উর্দু ভাষা সম্পর্কে কোনোকিছু জানার আগে। ষাটের দশকের মধ্য ভাগে। তখন আমার বয়স বড় জোর দশ বছর।

প্রতি সন্ধ্যায় রূপকথা সিনেমা হলে মুভির ফার্ষ্ট শো’র আগে, রাত সাড়ে নয়টায় সেকেন্ড শো’র আগে মাইক্রোফোনে উচ্চ আওয়াজে উর্দু/হিন্দি গানের রেকর্ড বাজানো হতো। শুনে শুনে একটি গান মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল: “জো ওয়াদা কিয়া ও নিভানা পড়েগা/রুকে জমানা চাহে রুকে খোদায়ি তুমকো আনা পড়েগা —-।” এর অর্থ কিছুই বুঝতাম না। তবুও কথা ও সুর ভালো লাগতো। আরও পরে যখন রেডিওতে ‘সিলন রেডিও’র পুরোনো গানের অনুষ্ঠান শুনতাম তখন গানগুলো কোন মুভির, গীতিকার- সুরকার ও গায়ক-গায়িকা কে তা শুনতাম। তখন সাহির লুধিয়ানভির নাম জানতে পারি। এভাবে তাঁর কবিতা ও গানের অনুরাগীতে পরিণত হই।

তাঁর লেখা সব কবিতা আমি না পড়লেও তাঁর লেখা গান হয়তো সবই শুনেছি। তাঁর লেখা বহু গান শুনে মনে হবে এ গান সাহির লুধিয়ানভিই সৃষ্টি করতে পারেন। “না তু জমি কে লিয়ে, হ্যায় না আসমাঁ কে লিয়ে/তেরা অজুদ, তেরা অজুদ হ্যায় আব সিরফ দাস্তাঁ কে লিয়ে —“ তুমি পৃথিবীর জন্য নও, আকাশের জন্যও নও/তোমার অস্তিত্ব, তোমার অস্তিত্ব তো এখন শুধু কাহিনির জন্য।) ধর্মীয় কলহের উর্ধে মানবতার চেতনা জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি লিখেছেন: “তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনেগা?/ইনসান কা আওলাদ হু ম্যায় ইনসান বনেগা—” (তুমি কি হিন্দু হবে, না কি মুসলমান হবে?/আমি তো মানুষের সন্তান, আমি মানুষ হবো।) প্রেমের গানেও শব্দে আবেগের পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন: “আভি না জাও ছোড় কর, কে দিল আভি ভরা নেহি/আভি আভি তো আয়ি হো, বাহার বন কে ছায়ি হো—” (এখনই আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, আমার হৃদয় এখনও পরিপূর্ণ হয়নি/এখনই তো এলে, বসন্ত হয়ে ছেয়ে আছো।) তাঁর অপূর্ব সৃষ্টির দৃষ্টান্ত স্বল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়।

সাহির লুধিয়ানভি ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি ও গীতিকার ছিলেন। ১৯২১ সালে পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবদুল হাই হলেও কবি হিসেবে ‘সাহির’ (জাদুকর) নাম গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর নামের যথার্থতা প্রমাণ করেছেন তাঁর কবিতার শব্দ, ছন্দ ও রূপকল্পের মধ্য দিয়ে। তাঁর শৈশব কেটেছে দারিদ্রে ও জীবনের তিক্ততার মধ্যে। কারণ তাঁর শৈশবেই তাঁর বাবা-মা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। বাবা অপর এক মহিলাকে বিয়ে করেন।

তাঁকে নিয়ে তাঁর মায়ের জীবন কাটে। দুঃখজনক ঘটনাগুলো তাঁর হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার প্রকাশ ঘটে ২৪ বছর বয়সে ‘তলখিয়াঁ’ (তিক্ততা, ১৯৪৫) নামে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার বইয়ে।

স্কুল ও কলেজ জীবন থেকে সাহির লুধিয়ানভি নিয়মিত লিখতেন এবং তখন থেকে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুধু করেন। লুধিয়ানার খালসা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং এসসি ধাওয়ান সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে ১৯৪৩ সালে তিনি লাহোরে দয়াল সিং কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি লাহোরের সাহিত্যিক মহলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ভালোই কাটছিল তাঁর লাহোরের দিনগুলো এবং লাহোরেই কাটাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দেশবিভাগের সময় সংঘটিত ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করার পর নতুন দেশ পাকিস্তানের প্রতি প্রাথমিক মুগ্ধতা কাটতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। তিনি কয়েকটি উর্দু সাময়িকীর সম্পাদনা করতেন এবং বামপন্থী কবি-লেখকদের সংগঠন ‘প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশন’ সদস্য ছিলেন। কমিউনিজমকে এগিয়ে নিতে তাঁর বক্তব্যের জের ধরে পাকিস্তান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে এবং ১৯৪৯ সালে তিনি পাকিস্তান ত্যাগ দিল্লিতে চলে যান এবং সেখান থেকে যান বোম্বে। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাফল্য তার পদচুম্বন করেছে।
বোম্বের ফিল্মের সেরা গীতিকার হিসেবে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতেন এবং তাঁর চলচ্চিত্র শিল্প তাঁকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এনে দেয়। কিন্তু তাঁর মেজাজী স্বভাবের কারণে তিনি বিতর্কিত হয়ে পড়েছিলেন।

তিনি চাইতেন যে চলচ্চিত্রের কাহিনি তৈরি করতে হবে তাঁর লেখা গানের জন্য, অন্য কোনোভাবে নয়। তাঁর লেখা গান যদি লতা মঙ্গেশকরও কণ্ঠ দিতেন, তাহলেও গানটির জন্য তাঁকে লতা মঙ্গেশকরের সম্মানীর চেয়ে তাঁকে অন্তত এক রুপি বেশি সম্মানী দিতে হবে। সাহির তাঁর সমসাময়িকদের মত ‘খুদা’ (ইশ্বর), ‘হুসন’ (সৌন্দর্য) ও ‘জাম’ (মদ) এর প্রশংসা করতেন না। তিনি বরং তিক্ত, কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ওপর স্পর্শকাতর কবিতা লিখতেন। তাঁর প্রেমের গানে আছে বিষাদ, তিনি তাঁর উপলব্ধি প্রকাশ করতেন যে প্রেমের চেয়ে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যার ওপর আলোকপাত করা উচিত।

সাহির লুধিয়ানভিকে যদি ভাগ্যহত মানুষের চারণ কবি বলা হয়, তাহলে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর হৃদয়ের কাছে বসত করতো দেনার দায়ে বিধ্বস্ত কৃষক, অন্য কারও জন্য যুদ্ধে লড়তে যাওয়া সৈনিক, দেহ বিক্রয় করতে বাধ্য নারী, বেকারত্বের কারণে হতাশ যুবক এবং রাস্তায় বসবাস করা পরিবার। সাহির তাঁর কল্পনার প্রেমিকাকে বলেন:

“মেরে মেহবুব কাহি আউর মিলা কর মুঝসে,
বাজম-এ-শাহি মেঁ গরিবোঁ কা গুজর ক্যায়া মানে,
সবত জিন পর হ্যায় সতবত-এ-শাহিকে নিশাঁ
উসপে উলফত ভরি রাহো কা গুজার ক্যায়া মানে।” (তাজমহল)

অর্থ:
“আমার প্রিয়, এখানে নয়, আমার সঙ্গে অন্য কোথাও দেখা করো,
যদিও এই সৌধ বহু বছর ধরে বিলাসী সম্রাটের প্রতীক হয়ে আছে,
বিখ্যাত না হলেও শাসকের সৌন্দর্যের চিহ্নের প্রয়োজন পড়ে না,
সেখানে মিলিত হতে হলে পাড়ি দিতে হয় ভালোবাসার পথে।”

এই কবিতা তিনি লেখেন মাত্র ১৯ বছর বয়সে, তিনি যখন কলেজের ছাত্র। কবিতাটির দুটি লাইন মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো:

“এক শাহানশাহ নে দওলত কে সাহারা লে কর,
হাম গরিবো কা মুহব্বত কো উড়ায়া হ্যায় মজাক,
মেরে মেহবুব, কাহি আউর মিলা কর মুঝছে।”

অর্থ:
“এক সম্রাট সম্পদের সাহায্য নিয়ে,
আমাদের মত দরিদ্রের প্রেমকে ঠাট্টা করেছে,
আমার প্রিয়, এখানে নয়, আমার সঙ্গে অন্য কোথাও দেখা করো।”

“যুদ্ধ এবং শান্তি” নামে সাহির লুধিয়ানভি’র একটি কবিতায় যুদ্ধের অসারতার কথাগুলো তুলে ধরা হয়েছে চমৎকারভাবে:

‍‍“খুন আপনা হো ইয়া পরায়া হো
নসল-এ-আদম কা খুন হ্যায় আখির,
জং মাশরিক মে হো ইয়া কে মাগরিব মে
আমন-এ-আলম কা খুন হ্যায় আখির।
জং তো খুদ এক মাসলা হ্যায়
জং মাসলো কা হাল কিয়া দেঙ্গে?
খুন আউর আগ আজ বখশে গি
ভূখ আউর এহতেয়াজ কাল দেগি।
ইস লিয়ে এ্যয় শরীফ ইনসানোঁ’
জং টালতি রাহে তো বেহতর হ্যায়,
আপ আউর হাম সভি কে আঙ্গন মেঁ
শামা জলতি রাহে তো বেহতর হ্যায়।
বারতারি কে সুবুত কি খাতির
খুন বাহানা হি কিয়া জরুরী হ্যায়?
ঘর কি তরিকিয়াঁ মিটানে কো
ঘর জ্বালানা হি কিয়া জরুরী হ্যায়?”

অর্থ:
“রক্ত আমার নিজের হোক বা অন্যের হোক
সে রক্ত তো আদম সন্তানেরই রক্ত,
যুদ্ধ পূর্বদিকেই হোক অথবা হোক পশ্চিমে
এটা তো বিশ্ব শান্তিকে হত্যার শামিল।
যুদ্ধ তো স্বয়ং একটি বড় সমস্যা
যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়।
যুদ্ধ আজ দেবে আগুন এবং রক্ত
আগামীকাল দেবে ক্ষুধা এবং অভাব।
অতএব, হে ভদ্রমহোদয়গণ,
যুদ্ধের নিজেকে জ্বলতে দেওয়াই ভালো
আমি এবং আমাদের সবার আঙিনায়
প্রদীপ জ্বলতে থাকলেই তো ভালো।
কারও মহত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য
রক্তপাত ঘটানোর কি প্রয়োজন আছে?
ঘরের অন্ধকার দূর করার জন্য কি
বাড়িতে আগুন লাগানো জরুরী?

সাহির লুধিয়ানভি’র সৃষ্টিই উপমহাদেশের কবিতা ও সঙ্গীত প্রেমিকদের কাছে তাঁকে অমর করে রাখবে। তিনি ১৯৭১ সালে ভারতের সম্মানজনক বেসামরিক রাষ্ট্রীয় পদক ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত হন। গীতিকার হিসেবে তিনি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসহ বহু পুরস্কার লাভ করেন। তিনি চিরকুমার ছিলেন। প্রচুর মদ্যপান করতেন এবং বন্ধুদের আপ্যায়ন করতে পছন্দ করতেন। তিনি রোমান্টিক কবি হলেও বাস্তববাদী ছিলেন:

“কাল কোঈ মুঝকো ইয়াদ কারে,
কিউ কোঈ মুঝকো ইয়াদ কারে?
মাসরুফ জমানা মেরে লিয়ে,
কিউ ওয়াক্ত আপনা বরবাদ কারে।”

অর্থ:
আগামীকাল কেউ কি আমাকে মনে করবে,
কী কারণে কেউ আমাকে মনে করবে?
আমার মৃত্যুর পর এই ব্যস্ত পৃথিবী,
কেন আমার জন্য সময় নষ্ট করবে?
সাহির লুধিয়ানভি ১৯৮০ সালে ৫৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।