ড. তাসনিম সিদ্দিকী
বেশ কিছুদিন আগে জেনেভায় ‘এথিক্যাল রিক্রুটমেন্ট’ বিষয়ক একটি কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেই সময় বেশকিছু অনিয়মিত অভিবাসীর সঙ্গে গভীরভাবে মেশার সুযোগ হয়। তাদের প্রথম অভিযোগ আমার প্রতি ছিল এ রকম- ‘আপনি তো এখানে এসেছেন আমাদের আসা বন্ধ করতে।’ তারা আরও বললেন, আপনি যে রিক্রুটমেন্টকে আনএথিক্যাল বলছেন, সেই রিক্রুটমেন্ট যারা করায় (দালাল), তাদের জন্যই আজ আমরা এখানে আসতে পেরেছি এবং খুব ভালো আছি। আমাদের কখনও মনে হয় না যে, অনিয়মিত পথে আমাদের বিদেশে আসা ভুল ছিল। তাদের একজন জানান, তিনি বিভিন্ন দেশ ঘুরে ফ্রান্স সীমান্ত দিয়ে সুইজারল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন। এই যাত্রাপথে তার দুই থেকে তিন বছর সময় লেগেছে। তার স্ত্রী বলেন, সুইজারল্যান্ডে থাকার অন্য কোনো উপায় নেই বিধায় আমার স্বামী এক সুইস নারীকে ‘কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ’ করেন। কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের শর্তানুযায়ী ছয় বছর সেই নারীর খরচ বহন করেন। পরে ওই সুইস নারীর স্বামী হিসেবে তিনি সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব লাভ করেন। তারপর সেই সুইস নারীর সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আমাকে পুনরায় বিয়ে করে এদেশে নিয়ে আসেন।
আরেক ব্যক্তি বলেন, আমি লক্ষ্মীপুরের একটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেছি। যদি আমি দেশে থেকে যেতাম, তাহলে বড় জোর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার চাকরি পেতাম। আমি এদেশে এসে এক সুইস নারীকে বিয়ে করেছি। তিনি আমার চেয়ে ১০-১২ বছরের বড়। তাকে বিয়ে করার মাধ্যমে আমি সুইজারল্যান্ডে থাকতে পারছি এবং প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা উপার্জন করতে পারছি। এখানে আমি অনিয়মিত উপায়ে এসেছি। যে দালাল আমাকে এ কাজে সহযোগিতা করেছেন, আমি তার মঙ্গল কামনা করি এবং প্রার্থনা করি- তিনি যেন আমার মতো আরও অনেকের উপকার করতে পারেন। একইভাবে ইতালি সফরে এক অভিবাসীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। তিনি জানান, ঢাকা থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে জাহাজে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে ইরান, ইরান থেকে স্পেন এবং স্পেন থেকে ইতালিতে পৌঁছেন। সেখানে তিনি কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে মাসে তিন থেকে চার লাখ টাকা উপার্জন করেন। তার উপার্জনেই চলে পুরো পরিবার। তিনি সিরাজগঞ্জের ছেলে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে দরিদ্রতা তীব্র বলে এসব মানুষ অনিয়মিত অভিবাসন করছেন, তা নয়। দ্বিতীয়ত, এখানে উন্নয়ন ঘটছে না বলে তারা চলে যাচ্ছেন, তাও নয়। এই অনিয়মিত অভিবাসনের মূল কারণ হলো, তারা একটি উন্নত জীবনধারার স্বপ্ন দেখেন। সিনেমা, নাটক কিংবা সিরিয়াল থেকে তারা সেই জীবনধারা উপভোগে উদ্বুদ্ধ হন। অনেকেই অনিয়মিত অভিবাসনের ক্ষেত্রে এককভাবে দালালদের দোষারোপ করে থাকেন। কিন্তু এর যে আনেক চাহিদা রয়েছে, সেদিকে তারা গুরুত্ব দিতে চান না। উন্নত জীবন কাটানোর এই স্বপ্ন একজনের কাছ থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হয়। এই স্বপ্নপূরণে জীবন বাজি রেখে পাড়ি জমান অনিশ্চিত যাত্রায়। যারা এ ধরনের অভিবাসন করছেন, তাদের জীবনবোধ বদলে গেছে। কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ কিংবা অনিয়মিত কাজকে তারা মন্দ ভাবছেন না। তারা ধরেই নিয়েছেন, উন্নত জীবনপ্রাপ্তির এটাই একমাত্র উপায়। তারা মনে করেন, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের সুযোগ দেয়নি বৈধভাবে অভিবাসন করার।
এর ফলে আমরা কিছুদিন পরপর সমুদ্রপথে প্রাণহানির চিত্র দেখি। গত ৩০ আগস্ট সমকালে এ সংক্রান্ত দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৩৯ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ইতালির উপকূল থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করেছে দেশটির কোস্টগার্ড, যাদের উল্লেখযোগ্যই বাংলাদেশি। আরেক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মাল্টার কারাগারে বন্দি বাংলাদেশিদের করুণদশা। এসব বন্দি আসলেই বাংলাদেশি কিনা, তা নিশ্চিত হতে ইতোমধ্যে মাল্টা সফর করেছে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল। তাদের সফরের পর সরকার চিন্তা করছে, এসব মানুষ অনিয়মিত অভিবাসনের মাধ্যমে সেখানে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। সুতরাং তাদের জেলে নেওয়া দরকার।
তবে, আজকের বিশ্বায়ন নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে, কিছু কিছু অভিবাসন বৈধ হবে, আর কিছু কিছু অভিবাসন এভাবে অনিয়মিত হবে। অনিয়মিত অভিবাসন রোধে আমাদের শাস্তির বিধান আছে। এ ক্ষেত্রে দালাল, মানব পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার চিন্তা আমাদের আছে। কিন্তু অভিবাসনের দেশগুলোর বাস্তবতাকে আমরা প্রশ্ন করছি না। ইউরোপীয় কমিশন অনিয়মিত অভিবাসীদের তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে, সে পরিমাণ অর্থ যদি তারা আমাদের মতো দেশে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করত, তাহলে তারা অনিয়মিত অভিবাসী হয়ে আসত না। অভিবাসনের দেশগুলোতে অনিয়মিত অভিবাসীদের নামমাত্র মজুরি দিয়ে সেখানকার উদ্যোক্তারা নিজেদের কাজ করিয়ে নিতে চায়। অর্থাৎ ওই দেশগুলো তাদের উদ্যোক্তাদের সঠিক মজুরি দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ করতে বাধ্য করছে না। সেখানকার যে উদ্যোক্তারা অনিয়মিত অভিবাসনে উদ্বুদ্ধ করছে, তারা কোনো শাস্তি পাচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের অনিয়মিত অভিবাসন অব্যাহত রয়েছে।
আগেই বলেছি, শুধু দরিদ্রতার কারণে বাংলাদেশ থেকে কেউ অনিয়মিত অভিবাসন করে না। তাহলে কেন যাচ্ছে? এর বড় কারণ হচ্ছে, এখানে সবার জন্য এক নীতি কার্যকর নয়। অর্থাৎ দেশে চাকরি পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়। দেশে চাকরি পেতে যদি ৫-১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়, তাহলে সমপরিমাণ টাকা খরচ করে অভিবাসন কেন করবেন না? দেশে মেধার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমরা কোটা পদ্ধতি সৃষ্টি করেছি। যার ফলে ৫১ শতাংশ চাকরি বিভিন্ন কোটায় চলে যাচ্ছে। এখানে মেধার ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ কম থাকায় অন্যভাবে যোগাযোগ করে কিংবা ঘুষ বিনিময়ের মাধ্যমে চাকরি পেতে হয়। এসব বিষয় তরুণদের অনিয়মিত অভিবাসনে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করছে।
অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করতে হলে শুধু অভিবাসন প্রক্রিয়ায় হাত দিলে চলবে না, বরং দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসন আনতে হবে। যেন এর ভেতরেই মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তা না হলে এভাবেই মানুষ সমুদ্রপথে কিংবা কোনো বন্দিশালায় বলি হতে থাকবে। বিভিন্ন দেশের কারাগারে কাটবে তাদের দুঃসহ জীবন। কিছুদিন পরপর আমরা সংবাদমাধ্যমে এ মৃত্যুর খবরগুলো দেখতে থাকব।
আমাদের দেশ থেকে এথিক্যাল রিক্রুটমেন্ট সেভাবে হচ্ছে না। এথিক্যাল রিক্রুটমেন্টের অর্থ হলো- অভিবাসন প্রক্রিয়া বৈধ হতে হবে। যে চাকরির কথা বলে তাদের পাঠানো হচ্ছে, তারা সে চাকরিই পাবেন, তারা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করে নির্দিষ্ট বেতন পেয়ে দেশে ফিরে আসবেন। আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারছে না। অভিবাসনের দেশগুলোতে শ্রমিকদের যেসব ক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেখানে মানবাধিকারের বালাই নেই। তাদের দাসের মতো খাটানো হয় নিয়মিত অভিবাসনের পরও। নিয়মিত অভিবাসনের চিত্র এমন হলে অনিয়মিত অভিবাসনে মানুষ কেন যাবে না? অভিবাসনের ক্ষেত্রে এ অন্ধকার কাটবে না, যতক্ষণ আমরা সামগ্রিক বিশ্বায়নকে নৈতিক করতে না পারি। অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)