বাংলাদেশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‍্যাব এবং এর সাবেক ডিজি ও বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদসহ সাতজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়েছে।

দেশটিতে নানা আলোচনা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণ এবং প্রভাব নিয়ে। এই নিষেধাজ্ঞা কোন ধরনের-কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে এবং ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান হিসাবে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে বাহিনীটির অন্য সদস্যদের ওপর কি কোন প্রভাব পড়বে-এসব প্রশ্ন নিয়েই চলছে এখন আলোচনা।

নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে একতরফা বলে বর্ণনা করা হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে। কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত এলো-এই প্রশ্ন তুলেছেন মন্ত্রীদের অনেকে।

নিষেধাজ্ঞার খবরটি প্রকাশ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বা অর্থ দপ্তরের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক জাভেদ ইকবাল মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সিদ্ধান্তের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আলোচনা বা কোন কৈফিয়ত দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

“পদ্ধতি হচ্ছে, এটা পুরোপুরি স্টেট ডিপার্টমেন্ট (যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর) ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বা রাজস্ব বিভাগ আর হোয়াইট হাউজের ওপর নির্ভর করে। এর জন্য কংগ্রেসে কোন বিল প্রয়োজন হয় না,” বলছেন ইকবাল।

তিনি আরও বলেন, ট্রেজারি বিভাগ নিষিদ্ধের তালিকা করে, সেখানে তালিকাভুক্তদের এসডিএন বলা হয়।

”সেটা কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং জাহাজের মতো প্রাণহীন জড়ো বস্তুও হতে পারে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যখন এসডিএন ঘোষণা করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কোন নাগরিক এবং কোন আর্থিক বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, তালিকাভুক্ত ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে টাকা পয়সা লেনদেন করতে পারবে না।”

কোন দেশের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষেত্রে কংগ্রেসে যদিও কোন আলোচনার প্রয়োজন নেই কিন্তু এর পেছনে অভিযোগ যা আনা হচ্ছে, তার সমর্থনে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সময় অভিযোগও প্রকাশ করা হয় না বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কমিশনার ছিলেন ডেমোক্র্যাট রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ড. নীনা আহমেদ।

তিনি বলেছেন, র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা হয়তো গেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া, চীন বা মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশকে এক কাতারে ফেলা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

“র‍্যাবের সমস্যাগুলো তুলে ধরে একইভাবে চায়না, উত্তর কোরিয়া বা মিয়ানমারের সাথে (বাংলাদেশকে) দেখানো হলো-এটা আমার কাছে খারাপ লেগেছে।”

তিনি বলছেন: “হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশনের অভিযোগ এলে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মূল্যায়ন করে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছ থেকে তথ্য প্রমাণ নেয়া হয়।

“এর ভিত্তিতে মানবাধিকার কমিশন যে রিপোর্ট দেয়, সেই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে তারপর সিদ্ধান্তটা আসে,” বলেন ড: নীনা আহমেদ ।

তিনি এই বিষয়গুলোকে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হিসাবে উল্লেখ করেন।

র‍্যাব ২০০৪ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অনেক অভিযোগ ওঠে।

এনিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময় কঠোর সমালোচনাও করেছে।

এখন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ এনেছে।

আর এসব ঘটনায় বিরোধীদলের সদস্য, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীরা টার্গেট ছিলেন বলে বলা হয়েছে।

টেকনাফে ২০১৮ সালে মাদক বিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সেখানকার পৌর কাউন্সিলর এবং স্থানীয় যুবলীগ নেতা একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে সে সময় রেকর্ড করা একটি টেলিফোন অডিও প্রকাশ হওয়ার পর তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে এই ঘটনাকে অন্যতম কারণ হিসাবে তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।
নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কার্যকর করা হয়

এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা হয় কীভাবে -এই প্রশ্নেও এখন অনেক আলোচনা চলছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক জাভেদ ইকবালের মতে, প্রতিষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এবং তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোতে র‍্যাবের অস্ত্র বা সরঞ্জাম কেনাকাটায় বা অর্থিক লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারি থাকবে।

“র‍্যাব যদি আমেরিকার কোন প্রতিষ্ঠান থেকে অস্ত্র কিনতে চায় অথবা আমেরিকায় কোন ট্রেনিংয়ে আসতে চায়, সেটা আর পারবে না। আমেরিকার যে মিত্র দেশগুলো আছে, আস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং যুক্তরাজ্য- এই দেশগুলো এখন থেকে র‍্যাবকে খুব নজরদারিতে রাখবে। এটা হচ্ছে প্র্যাকটিক্যাল আসপেক্ট (বাস্তব দিক),” বলেন জাভেদ ইকবাল।
র‍্যাবের অস্ত্র সরঞ্জাম কেনার নীতি কী হবে

র‍্যাবের অস্ত্র বা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে এই বাহিনী এবং সরকারের নীতিতে কোন পরিবর্তন আসবে কিনা-সেটা এখনই বলা মুশকিল। র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, বিরূপ কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তখন সরকার করণীয় ঠিক করবে বলে তারা মনে করেন।

তিনি বলছেন, সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে তারা অস্ত্র ও সরঞ্জাম কিনে থাকেন, সেখানে সুনির্দিষ্ট কোন দেশ থেকে কেনার বিষয় নেই।

“আমরা এখনও আশা করি, সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন ভাল দেশ থেকে নিশ্চয়ই গোয়েন্দা সরঞ্জামাদি ক্রয় করতে আমরা সক্ষম হবো। কারণ এখন পর্যন্ত কোন সমস্যার মুখোমুখি আমরা হইনি। ভবিষ্যতে মুখোমুখি হলে তখন সরকার করণীয় ঠিক করবে,” বলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।-বিবিসি

এখন সময়/শামুমো