ডিমের যাতনায় ইলিশ মাছ মোহনায় চলে আসে, কচ্ছপ পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠে আসে, আর কবিতা প্রসবের যন্ত্রণায় কবিরা বসে টেবিলে। নিজের ভেতর লেখালেখি করার ভিত্তি তৈরির জন্য প্রচুর পড়তে হবে অন্যের লেখা, অথচ লিখতে হবে একান্ত নিজস্ব বিষয়গুলো, ব্যক্তিগত ভাবনাগুলো। লেখালেখির ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পারাটা জরুরী, না হলে মানব মনে প্রভাব বিস্তার করা যাবে না, টিকে থাকা তো পরের কথা।

একজন সাহিত্যিকের জন্য সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, তার মৃত্যুর পরও তার লেখাগুলো পৃথিবীতে থাকবে এবং পাঠকের চিন্তা-চেতনাকে পরিবর্তনে প্রতিনিধিত্ব করবে। বই পড়ার চেয়ে বই লেখা অন্তত একশোগুন কঠিন কাজ। মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানে বাঙালিরা সহজ কাজটা ফেলে কঠিন কাজটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। একটা সময় গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজের নাম জাহির করার জন্য নির্বাচনে দাঁড়াতো। চেয়ারম্যানী বা মেম্বারী। তারপর মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করে পোস্টার ছাপিয়ে পাড়া-মহল্লা মাতিয়ে তুলতো। এখন শিক্ষিত লোকেরা গাঁটের টাকা ভেঙে নিজের নামে বই প্রকাশ করে। এ ধরনের লেখকদের বই প্রকাশ হওয়া বিয়ের কার্ড ছাপা হওয়ার মতো। নিজের খরচে ছাপিয়ে নিজ দায়িত্বে তারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে দিয়ে আসে। তবু লেখক তকমা গায়ে পরা চাই!

কিছু অসাধু প্রকাশক লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই প্রকাশ করে। সেক্ষেত্রে প্রকাশক সাহেব লেখার মানের চেয়ে পুস্তক প্রকাশ বাবদ অর্থ প্রাপ্তিকে বেশি গুরুত্ব দেন। টাকা পেলে তারা পুরনো ডায়েরি, জমা খরচের টালি খাতা, এমনকি নিত্যদিনের বাজারের ফর্দকেও কবিতার বই বলে ছাপিয়ে দিতে পারেন। ফলে নিম্নমানের বইয়ে বাজার ভরে যায়। প্রকাশকদের এমন অর্থলিপ্সু বাণিজ্যিক মনোভাবের সবচেয়ে বেশি শিকার হন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বড়লোকের উঠতি বয়সী সন্তান ও বিদেশী স্বামীর গৃহপরিচালিকা স্ত্রীরা। কারণ তাদের টাকা উড়ানোর মতো পর্যাপ্ত টাকার অভাব নেই। তাই লেখক হওয়ার লোভে প্রকাশকদের ফাঁদে পা দেন। কবি হবার লোভ সবচেয়ে বড় লোভ।

প্রচুর লেখার চেয়ে অল্প কয়টা ভালো লেখা লিখতে পারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর পর্যাপ্ত প্রচার করতে না পারলে ভালো লেখা লিখেও তেমন লাভ নেই। নিম্নমানের একটি বই লেখককে এতটা নিচে নামিয়ে দিতে পারে যে, দশটি ভালো মানের বইও তাকে সেখানে থেকে টেনে তুলতে পারবে না। বই প্রকাশের সময় মাথায় রাখতে হবে যেন পাঠক বইটির প্রতিটা পৃষ্ঠা পড়ার পর পরবর্তী পৃষ্ঠাটি পড়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং বইটি পাঠ শেষে একই লেখকের আরো কোন বই পড়ার জন্য আগ্রহ দেখায়। বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ, বাধাই, কাগজের গুণগত মান ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার চেয়ে বইটির কালো অক্ষরে ছাপা বাক্য গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সংবাদপত্রে ও ম্যাগাজিনে লেখালেখিকে অনেকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। সম্পাদকদের ফরমায়েশে বা পীড়াপীড়িতে লেখা রচনা করে। পেশাদার লেখক হতে পারলে লেখার মান কিছুটা কমে যায়, তবে লেখালেখি শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখা যায়। আর্থিক উন্নতি না ঘটলে জনগণ কোন কাজকে কাজ বলে মানতে চায় না।

বই বেচার চেয়ে পাঠক তৈরি করাটা বেশি জরুরী। পাঠক বিহীন বই আর কাঠ চেড়াই কল থেকে ছিটকে পড়া এক টুকরো কাঠের তক্তার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কল্পনা শক্তি যার যত দুর্বল, বই পড়ে সে তত কম আনন্দ পায়। কল্পনা ক্ষমতা না থাকা লোকেরা বই পড়াকে কারারুদ্ধ জীবনের মতো যন্ত্রণার মনে করে। অনেকের মতে বই পড়া নিষ্কর্মা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাজ, নিম্নবিত্তরা বই পড়াকে ফালতু শখ ভাবে, আর উচ্চবিত্তরা বই কেনে ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখার জন্য।

যদি আপনি নবীন লেখক হন, যদি আপনার নতুন প্রকাশিত বইটা কাউকে সৌজন্যমূলক দান করেন, সে ভাববে এটা তার প্রাপ্য ছিল। আর যদি আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক হন, সেই লোকটাই আপনার বই ডাবল দামে কিনে অটোগ্রাফ নেওয়ার আশায় পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পেরে ভাববে এ আপনার দুর্লভ দয়া। কাউকে বইয়ের সৌজন্য সংখ্যা না দেওয়াই ভালো। সৌজন্য সংখ্যা পেয়ে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বইটার অবমূল্যায়ন ও অপব্যবহার করে। তারা আপনাকে চিনে বলে ভাববে – “এ আবার তেমন কী লেখলো!” তারপর আপনার বইটাকে জানালার ভেঙে যাওয়া কাচের অংশে রেখে দেবে, যাতে বাহিরের কুয়াশা ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। খটখট করা টেবিলের পায়ার নিচে রেখে দেবে, যাতে টেবিলটা আর খটখটিয়ে না নড়ে। তবু বইটা পড়বে না। মাগনা বলদের দাঁত থাকে না।

একটা সময় পাঠকেরা কবি-সাহিত্যিকদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য বায়না ধরতো, আর এখন কবি-সাহিত্যিকরা পাঠকদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য তদবির করে। বইমেলাতে গেলে দেখা যায় লেখকেরা পাঠক ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত। কোন বই ক্রেতা পেলেই এমনভাবে বই কেনার জন্য পুশিং করতে থাকে, যেন ধরে বেঁধে বইটা কোন রকমে বিক্রি করতে পারলেই হলো। বইমেলাতে পাঠকদের পিছুপিছু লেখকদের এই ছোটাছুটি দেখে মনে হয় যেন শিকারের জন্য হরিণকে ধাওয়া করছে চিতাবাঘ। নিজের বইয়ের প্রচারের জন্য কিছু বই হকারের মত বগলদাবা করে পাঠকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন, তবে পরিচিত কারো কাছে জোর করে বই বিক্রি করবেন না। তারা হয়তো আপনার বইটা কিনে নেবে, কিন্তু চিরকাল আপনাকে হীনমন্য দৃষ্টিতে দেখবে ।

পৃথিবী বইয়ের হোক, মূল্যবান সব বইয়ে ভরে উঠোক প্রতিটি লাইব্রেরী। প্রত্যেক লেখক তার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটি তুলে দিক পাঠকের হাতে। পাঠক মননশীলতায় সমৃদ্ধ ও পরিতৃপ্ত হোক বই পাঠে।