সিনেমার পোকা ছিলাম আমি। সত্তরের দশক। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সিনেমা দেখি। বাংলা ইংরেজি কোনো ব্যাপার না। সিনেমা হলেই হলো। নতুন সিনেমা রিলিজ হবে আর আমি দেখবো না সেটি হবার নয়। আমার টাকা পয়সার পরিমাণ খুব সামান্যই ছিলো তখন। লেখার বিল, রেডিও-টিভিতে অনুষ্ঠান করা বাবদ পাওয়া অল্প কিছু টাকাই ছিলো আমার উপার্জন। সিগ্রেটের টাকা নাকি ভূতে যোগায়। আমি যেহেতু সিগ্রেট খেতাম না তাই বলা যায় আমার সিনেমার খরচটা ভূতেই যোগাতো। ভালো লেগে গেলে একটি সিনেমা বারবার বহুবার দেখতাম।

সেই সময়ের কাহিনি।
গুলিস্তান বিল্ডিং-এর ছোট্ট মুভি থিয়েটার ‘নাজ’এ মুক্তি পেলো শাদাকালো সিনেমা ‘এপার ওপার’।

পত্রিকা মারফৎ আগেই জেনেছিলাম নতুন একজন নায়িকার আগমন ঘটতে যাচ্ছে এপার ওপারের মাধ্যমে। ছবির নায়ক নায়িকা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ছবির নামটি ছিলো যথার্থ। নায়ক সোহেল রানা ঢাকা অর্থাৎ এপারের আর নায়িকা সোমা মুখার্জি ওপারের, অর্থাৎ কলকাতার। ছবির পরিচালক মাসুদ পারভেজ আর সোহেল রানা যে একই ব্যক্তি সেটাও আমার জানাই ছিলো। সোহেল রানা থাকেন ঠাটারি বাজার লাগোয়া বিসিসি রোডে। আর আমি ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিটে। হাঁটাপথের দূরত্ব। প্রায় নিজের মহল্লার নায়ক বলে ছবিটার ব্যাপারে আলাদা একটা আকর্ষণও কাজ করছিলো আমার ভেতরে। কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত চরিত্র ‘মাসুদ রানা’র মাধ্যমে নায়ক সোহেল রানার অভিষেক ঘটলেও আমার মুগ্ধতা কেড়ে নেন তিনি ‘এপার ওপারে’র মাধ্যমে।

নাজ ছিলো ঢাকার সবচে খুদে সিনেমা হল। সিট সংখ্যা বড়জোর শ খানেক। নবাবপুর স্কুলের ছাত্র ছিলাম বলে গুলিস্তান আর নাজের টিকিট সংগ্রহ করা আমার জন্যে সহজ ছিলো। অধিকাংশ টিকিট ব্ল্যাকার তখন আমার চেনাজানা, চেহারার সুবাদে। নিয়মিত দর্শক পরিচয়ের বাইরে নবাবপুর স্কুলের ছাত্র বলে ওরা আমাকে খানিকটা খাতিরও করতো। সুতরাং সিনেমা সুপারডুপার হিট হলেও সামান্য কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট জোগাড় করে ফেলতাম যে কোনো শো-এর।
প্রথম ছবি ‘মাসুদ রানা’য় ড্যাসিং ইমেজের নায়ক সোহেল রানা দর্শকের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও দ্বিতীয় ছবি এপার ওপারে খুব মামুলি ডিজাইনের পাজামা আর একটা ফতুয়া টাইপ জামা পরা সোহেল রানা বাজিমাৎ করে ফেললেন। ঢাকার ছবির দর্শকরা সাদরে তাঁকে গ্রহণ করলেন।

আমি মুগ্ধ হলাম তাঁর হাসিতে। এইরকম মিষ্টি হাসির অধিকারী নায়ক আমাদের কি দ্বিতীয়টি আছে? এপার ওপারে নায়ক হিশেবে সোহেল রানার খুব স্বাভাবিক অভিনয় দেখে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঢাকার অন্য নায়করা তখন উচ্চমাত্রার উচ্চকণ্ঠ ঢিঁশ্যুম ঢুঁশ্যুম অভিনেতা। যাত্রার ঢঙে সংলাপ প্রক্ষেপনে অভ্যস্ত। এই ছবিতে সোহেল রানা আবির্ভূত হলেন নতুন ম্যানারিজমে, একটি সফট ইমেজ নিয়ে। এরকম ইমেজ ১৯৭৫ সালের ছবিতে তখন অকল্পনীয় ছিলো। বলা চলে এপার ওপার-এর মাধ্যমে রোমান্টিক সোহেল রানা জয় করে নিলেন সিনেমাপ্রিয় মধ্যবিত্ত বাঙালির হৃদয়।

এপার ওপারের গল্পটি এমন কোনো আহামরি ধরণের ছিলো না। আজারবাইজানের উপকথা ‘আলী ও আসমা’ থেকে আখ্যানটি ধার করা। শেষ দৃশ্যে নায়ক নায়িকা দুজনেই মারা গেলে ছবির দর্শকরা সেটা ভালোভাবে নেয় না এমনটাই দস্তুর ছিলো তখন। কিন্তু এই ছবির বিয়োগান্তক শেষ দৃশ্যটা দর্শক লুফে নিলো। শেষ দৃশ্যে নায়ক নায়িকা দুজনেই ডেড। ছবি হিট। ছবির চাইতে হিট ছবির গান।

নাজ সিনেমা হলে বসে ছবিটা দেখার সময় দুটো গান আমাকে দারুণ রকম চমকে দিয়েছিলো। গানের কথা সুর আর মিউজিক কম্পোজিশন এক কথায় দুর্ধর্ষ! এর একটি ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’ আর দ্বিতীয়টি ‘মন সঁপেছি আমি কারো মনের আঙিনায়’।প্রথমটির গায়ক আজাদ রহমান আর দ্বিতীয়টির আবদুল জব্বার। আজাদ রহমান এপার ওপারের সঙ্গীত পরিচালক। ভালোবাসার মূল্য কতো গানটির কথা ফজল-এ-খোদার। মন সঁপেছিরও। আমাকে তখন পেয়ে বসেছিলো ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’।

দিনরাত করোটির ভেতরে বারবার বহুবার ‘গুঞ্জরিয়া ওঠে’ গানটি। ১৯৭৫ সালে বাংলা ছবির ভিএইচএস কিংবা ডিভিডি পাওয়া যেতো না। তখন কোনো ছবির কোনো গান আমাকে একবার পেয়ে বসলে সেই ছবিটি আমি বারবার দেখতাম। এপার ওপারও দেখতে হলো কয়েকবার। স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে সেই টাকায় সিনেমা দেখতাম। আর সিনেমা দেখতাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। প্রতিটা ক্রেডিট লাইন (টেলিভিশনে যাকে আমরা টেলপ বলতাম) মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতাম।

এমন কি অপটিক্স হাসান মুদ্রণ পরিস্ফুটন ইউসুফ আলী খান খোকা পর্যন্ত। তো এপার ওপার ছবিতে কণ্ঠশিল্পী হিশেবে বিখ্যাত আবদুল জব্বারের পাশাপাশি আজাদ রহমান নামের একজন নতুন শিল্পীর নামও ঝলমল করে উঠলো পর্দাজুড়ে। ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’ শোনার সময়ই বুঝতে পারছিলাম—এটা কোনো চেনাজানা পরিচিত কণ্ঠ নয়। সিনেমায় আগে কখনোই শুনিনি তাঁর গান। আহারে কী অপূর্ব ব্যাতিক্রমী কণ্ঠ এই শিল্পীর! বারবার বহুবার দেখলাম এপার ওপার ছবিটা শুধু দুটো গানের জন্যে, বিশেষ করে ভালোবাসার মূল্য কতো।
আমার জীবন যাপনের অংশ হয়ে উঠলো ভালোবাসার মূল্য কতো গানটি। গুনগুন করে গাই। মুড ভালো থাকলে এবং আশেপাশে কেউ না থাকলে গলা ছেড়ে গাই। এই ঘটনার প্রায় তিন দশক পর যখন আমি অনিশ্চিত জীবনে প্রবেশ করে এইদেশ সেইদেশ ঘুরেটুরে কানাডায় এসে থিতু হলাম তখনো এই গানটা আমাকে ছেড়ে যায়নি। ইউটিউবে আমার একাউন্টে গানটা জমা রেখেছি। প্রায়ই নাগারে চলতে থাকে প্রিয় কণ্ঠশিল্পী আজাদ রহমানের ভালোবাসার মূল্য কতো।

সোহেল রানা আমাদের মহল্লার নায়ক। তাঁর আরেক ভাই কামাল পারভেজও নায়ক হয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র একটি ছবিতে। নাম ছিলো ‘জীবন নৌকা’। তাঁর ছোট ভাই নেহাল আমাদের বন্ধুর বন্ধু। তাঁর সবচে ছোট ভাই রুবেলও পরে নায়ক হলো। কুংফু ক্যারাটের মারদাঙ্গা নায়ক হিশেবে রুবেলও পেয়েছিলো বিপুল জনপ্রিয়তা। কিন্তু নায়ক সোহেল রানাই আমার মন কেড়েছিলেন, এপার ওপারের সুবাদে। তাঁর লিপ্সিং-এ ‘ভালোবাসার মূল্য কতো’ গানটি আজও শুনি আমি সমান আগ্রহে। মাঝেমধ্যে ইউটিউবের কল্যাণে সেই গানের দৃশ্যও অবলোকন করি। আহা কী মিষ্টি নায়ক ছিলেন সোহেল রানা!
কৈশোর পরবর্তী জীবনে, তুমুল যৌবনের দিনগুলোতে, এক সময় চাকরি সুবাদে আমি ‘চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা’ও করেছি দীর্ঘদিন। এবং ফিল্মি দুনিয়ার মানুষদের সঙ্গে তখন আমার একটা চমৎকার সুন্দর সম্পর্কও তৈরি হয়েছিলো। ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক’ সমিতির নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যও হয়েছিলাম। সে আরেক কাহিনি। সোহেল রানায় কনসেনট্রেড করি।

নায়ক সোহেল রানার সঙ্গেও আমার সখ্য হয়েছে। তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। আর সবার মতো আমিও তাঁকে পারভেজ ভাইই বলতাম। ফিল্মের বিভিন্ন পার্টিতে, ফাংশানে আমার সঙ্গে দেখা হতো পারভেজ ভাইয়ের। মুক্তিযোদ্ধা পারভেজ ভাইকে আমি পছন্দ করতাম আরেকটি কারণে। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালের উত্তাল সময়টায় মাসুদ পারভেজ ছিলেন ইকবাল হলের ভিপি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলটি ছিলো দুর্ধর্ষ একদল স্বাধীনতাপ্রেমী তরুণ যোদ্ধার আবাসস্থল। এই ইকবাল হলেরই আবাসিক ছাত্র ছিলেন খসরু(‘ওরা ১১জন’ সিনেমার নায়ক)। মাসুদ পারভেজ এবং খসরুদের গ্রুপটা ছিলো ভয়াবহ রকমের দুঃসাহসী। পশ্চিম পাকিস্তানীদের ত্রাস ছিলেন তাঁরা। যে কারণে আমরা দেখেছি—১৯৭১ সালে ঘৃণ্য ইয়াহিয়ার পালিত কসাই টিক্কা খানের পাকিস্তান বাহিনির কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর ছকে ঢাকার ইকবাল হলকে গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও ছিলো লিখিত আকারে। সেই মোতাবেক ২৫ মার্চ রাতে ইকবাল হলে অবস্থানকারী তাঁদের অনেক সহযোদ্ধাকেই হত্যা করেছিলো পাকিসৈন্যরা। স্বাধীনতার পর খসরুকে নায়ক করে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ নির্মিত হয়েছিলো। মাসুদ পারভেজ ছিলেন সেই ছবির প্রযোজক। মাসুদ পারভেজের বহু শিষ্য পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান করেছেন, ‘মন্ত্রী’ হয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে মাসুদ পারভেজ অনেক আগেই যা হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো বেছে নিলেন চলচ্চিত্রের অনিন্দ্যসুন্দর আলোঝলমল জগতকে। এবং সেই জগতের শীর্ষস্থানীয় একজন হিশেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি অপরূপ দক্ষতায়।
অনেকদিন পর এবছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে পারভেজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো চ্যানেল আই অফিসে। পারভেজ ভাই এসেছিলেন আমাদের অনন্যা রুমার প্রযোজনায় ‘তারকা কথন’ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। পুত্রসহ এসেছিলেন তিনি। পুত্রটি সদ্য যুবা। একহারা গড়ন। মস্তক ক্লিনশেইভড। পারভেজ ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে তাঁর একমাত্র পুত্রের। নাম ওর জিবরান। মাসরুর পারভেজ জিবরান। চলচ্চিত্রে আগ্রহী।

কিন্তু ঢাকার তথাকথিত ম্যাড়ম্যাড়ে চলচ্চিত্রে নয়। ওর চোখে মুখে ভিন্ন এক দ্যুতি। পছন্দ ওর হলিউডি মুভি। পারভেজ ভাই দেখলাম পুত্রটিকে বেশ সমঝে চলেন। ওদের দুজনার সম্পর্কটা যদিও খুবই ফ্রেন্ডলি। আমার কথাবার্তায় জিবরান মোটামুটি কনভিন্সড। এক পর্যায়ে সে তার বাবাকে বলেই ফেললো—বাবা দেখেছো আঙ্কেল কী রকম গুছিয়ে কিন্তু স্ট্রেইট কাট কথা বলেন! পারভেজ ভাই সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে ওর কথায় সায় দিচ্ছিলেন। জিবরান এবং পারভেজ ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা হলো। জিবরানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—আঙ্কেল তুমি কি জানো কী রকম জনপ্রিয়তা ছিলো তোমার বাবার? বললো–জানে সে। শুনেছে। তবে বাবার মতো নায়ক হতে চায় না সে। সে হবে অন্যরকম হিরো।

কথায় কথায় জানা হলো জিবরানের কিছু প্রিয় বিষয় আশয়। প্রশ্ন উঠতে পারে আমি কেনো জিবরানের মতো একজন সদ্য যুবা অতি নবীন অভিনেতার প্রিয় বিষয় আশয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি! আমি কি ফের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় আগ্রহী হয়ে উঠছি?(যদিও চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিশেবে আমি কখনো কারো প্রিয় বিষয় আশয় নিয়ে ফালতু রিপোর্টে সময় নষ্ট করিনি।) আসলে পারভেজ ভাইই চাইছিলেন আমি ওর বিশেষ করে প্রিয় খাবারের ব্যাপারে যেনো একটু কথা বলি। তো আমি অন্য আলাপের ফাঁকে কায়দা মতো প্রশ্নটা খুব ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করলাম জিবরানকে। জবাবটা দিলেন পারভেজ ভাই—ওর পছন্দ কেএফসি। ফ্রাইড চিকেন আর বার্গার।
আমি বললাম—এগুলো তো জাংক ফুড! এইসব জাংকফুড কি তুমি রেগুলার খাও?
জবাব এলো—হ্যাঁ। রেগুলার।

পারভেজ ভাই বললেন—অন্য কিছু সে খেতেই চায় না!
আমি বললাম—তাহলে জিবরান এরকম টানটান মেদহীন ফিগার মেনটেইন করছো কী ভাবে? তুমি তো মুটিয়ে যাবে!
জিবরান হাসে—আঙ্কেল আমি প্রতিদিন নিয়মিত এক্সারসাইজ করি।

–তার মানে জাংকফুড শরীরে জমতে দাও না? ঝরিয়ে ফেলো?
–এগজাক্টলি। ঝরিয়ে ফেলি।
খুব আক্ষেপ নিয়ে পারভেজ ভাই বললেন—ডিম এবং দুধ সে খেতেই চায় না। খায় না।

এ সময় জিবরান ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ওয়াস রুমে গেলো।
আমাকে অবাক করে দিয়ে এককালের দুর্ধর্ষ নায়ক ড্যাসিং হিরো সোহেল রানা ওরফে পারভেজ ভাই বললেন—তোমার কথাবার্তায় আমার ছেলেটা খুবই উৎফুল্ল দেখছি। ও তোমাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তোমার কথা সে বিশ্বাস করছে। তোমার যুক্তিতে সে কনভিন্সড। এখন তোমাকে একটা কাজ করতে হবে রিটন।

–কী করতে হবে পারভেজ ভাই বলুন, আমি করবো।
–ডিম এবং দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা যে জরুরি সেটা তুমি একটু বুঝিয়ে বলো ওকে। আমার বিশ্বাস ও তোমার কথা শুনবে।
কিছুক্ষণ পর জিবরান ফিরে এসে আমাদের পাশে বসলো।
আমি সরাসরি ডিম এবং দুধ বিষয়টি নিয়ে পড়লাম—শোনো আঙ্কেল, কানাডার টিভিতে দুটো বিজ্ঞাপন দেখানো হয় নিয়মিত। এর একটা হচ্ছে এগ মানে ডিম বিষয়ক আরেকটা মিল্ক অর্থাৎ দুধ বিষয়ক। বিজ্ঞাপন দুটোয় কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির নাম প্রচার করা হয় না। ওখানে দুধ আর ডিমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়। একজন মানুষের জন্মের পর থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়া এবং বার্ধক্যে পৌঁছানো পর্যন্ত এই দুটি জিনিসের গুরুত্ব তুলে ধরাই সেই বিজ্ঞাপন দুটোর উদ্দেশ্য। বিশেষ করে দুধের। ডিম কখনো কখনো বিশেষ কারণে কম খেতে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিশোর তরুণদের শরীরের স্বাভাবিক বিকাশের সময়টায় সেই বিধিনিষেধ থাকে না। একটা বয়েস পর্যন্ত শরীর গঠিত হয়। এই গঠন সময়টায় শরীরকে তার প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করতে হবে। তা নইলে ঘটতি থেকে যাবে শরীরের গঠন প্রক্রিয়ায়। একটা বয়েসের পর ক্ষয় হতে থাকে মানুষের শরীর। তখন, যার শরীরে পর্যাপ্ত রসদ মজুদ ছিলো তার ক্ষয়টা ঘটে স্লো মোশনে। কিন্তু যার রসদ কম ছিলো বা ঘাটতি ছিলো বা ছিলো না, তার ক্ষেত্রে ক্ষয়টা ঘটে দ্রুততার সঙ্গে, ক্ষিপ্র গতিতে। লক্ষ্য করবে একই বয়েসের দুজন মানুষের একজন বার্ধক্যে পৌঁছে গেছে আরেকজন তারুণ্য ধরে রেখেছেন। যেমন তোমার বাবা। তোমার বাবার বয়েসী অনেকেই সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারেন না। আর তোমার বাবাটা এখনো পর্দায় ফাইট করেন!

জিবরান হাসে। সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকায়।
আমি বলি—কানাডার টিভিতে দুধের বিজ্ঞাপনটা দারুণ। ওখানে দেখানো হয় দুধের মধ্যে থাকা ক্যালসিয়াম কীভাবে শরীরের হাঁড়কে শক্তিশালী ও মজবুত রাখে। একটা লোক দৌঁড়ুচ্ছে। লোকটার পা’দুটোকে ক্লোজ শটে এনে এক্সরে প্লেটের আদলে শুধুমাত্র শাদা হাঁড়ের ফর্ম্যাটটাকে বের করে আনা হয়। তারপর একটা পায়ের হাঁড়ের ফর্ম্যাটকে নিয়ে আসা হয় বিগ ক্লোজ শটে। এরপর দেখানো হয় সেই শাদা হাঁড় দুর্বল হয়ে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। তখন এক গ্লাস দুধ ঢেলে দেয়া হয় সেই হাঁড়ের ভেতরে এবং তাতে করে হাঁড়টা ফের ভরাট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দুধটা সরাসরি হাড্ডিতে রূপান্তরিত হলো। কী বুঝলে?
জিবরান হাসে—ড্যাড আপনাকে বলেছে আঙ্কেল…
–ইয়েস। বলেছে। দুধ আর ডিম না খেলে নায়ক হিশেবে তুমি তো বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না আঙ্কেল।
এরমধ্যে প্রযোজক অনন্যা রুমা চলে এসেছে রুমে। সেট রেডি। ওর তারকা কথনের আজকের অতিথি সোহেল রানা আর জিবরান। পিতাপুত্রের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হবে একটু পরেই। কারণ জিবরান আর ওর কাজিনের(কামাল পারভেজের পুত্র)পরিচালনায় হলিউডি প্যাটার্ণে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘অদৃশ্য শত্রু’ খুব শিগগিরই মুক্তি পেতে যাচ্ছে। ‘অদৃশ্য শত্রু’তে নায়কের চরিত্রটা করেছে জিবরান। যদিও ওর ফিল্মি নামটি জিবরান থাকবে না। ওর নাম হবে ইয়ুল রাইয়ান। তারকা কথন প্রতিদিনের সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান। আমি ওদের দুজনকে নিচতলায় স্টুডিও পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম।

পারভেজ ভাই তাঁর সেই বিখ্যাত সুইট হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। তাঁর চোখেমুখে এক ধরণের বিমূর্ত ভাষ্য ঝিলিক দিয়ে উঠলো। যার অনুবাদ—থ্যাংকিউ।
সন্তান বড় হতে থাকলে বাবারা কী রকম ছেলেমানুষ হয়ে পড়েন। বড় পর্দার এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সোহেল রানাকে তাঁর পুত্রের সঙ্গে দেখে সেটা আরেকবার মনে হলো আমার। (আমারও কি সেই একই অবস্থা?)

আমার সেদিনের দীর্ঘ লেকচারে কাজ হয়েছিলো কী না জানা হয়নি। কারণ তার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমি চলে এসেছি কানাডায়। জিবরান, আঙ্কেল, প্রতিদিন ডিম আর দুধ খাচ্ছো তো তুমি? (আমার মেয়েটাও তো খায় না!)

০৯ নভেম্বর ২০১৪

[আলোকচিত্র/রাকিবুল হক]