একের পর এক দৈহিক, মানসিক ও পারিবারিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ততা ও বিষাদ কাটছেই না আমার। তার উপরে আবার দেশ-সমাজের কঠিন বাস্তবতার আঘাতে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হতেই হচ্ছে। এমন অবস্থায় ফেসবুকে নিয়মিত হাজির থাকাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও দলবলহীন নিঃসঙ্গ ও বিপন্ন একজন মানুষের আকুতি সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া প্রকাশের আর কোনও মাধ্যমও নেই। যাই হোক, গুরুতর রোগাক্রান্ত অবস্থায় নগরীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার লেটেস্ট অবস্থা সম্পর্কে আজ হয়তো কিছুটা জানা যেতে পারে। এর আগে দেশবাসী বিভিন্ন মাধ্যমে অনেকটাই ধারণা পেয়েছেন।

সেলিমা ইসলাম একজন প্রবীণা নারী। গৃহবধু। রাজনীতি করেননি কখনো। বেগম খালেদা জিয়ার মেজো বোন। ডাক্তার জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বিএনপির কেউ নন। নাগরিক অধিকার আন্দোলনে জড়িত রাজনীতি সচেতন স্বাস্থ্যবিদ। এই দু’জনের ঋজু ও স্পষ্ট বক্তব্য সারা দেশকে আবারো জানিয়ে দিয়েছে খালেদা জিয়ার কথা। শতাব্দির মহীরুহ মওলানা ভাসানীর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে সকলে জেনেছে যে, ম্যাডাম দেশবাসীর দোয়া চেয়েছেন।

জাফরুল্লাহ্ জানালেন খালেদা জিয়ার ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা। সরকার যে প্রতি মুহূর্তে তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলছে, তিনি দিলেন সেই বয়ান। বলেছেন, কোনো অঘটন ঘটে গেলে হুকুমের আসামি হতে হবে ক্ষমতাসীনদেরকেই। আর সেলিমা ইসলাম পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিলেন, একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেলেও মাথা নোয়ানো হবে না। কোনো অন্যায় করেননি খালেদা জিয়া। তাই তাঁর পক্ষে পরিবারের ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্নই ওঠেনা। তাদের মুখ থেকেই বাংলাদেশ ও বিশ্ব নতুন করে জানলো খালেদা জিয়ার কথা।

এই কথাগুলো উচ্চারিত হওয়া উচিত ছিল সংসদে, সভামঞ্চে, মাইক্রোফোনে, মিডিয়ার সামনে দলের ও রাজনীতির মুখ থেকে এবং তা আরো আগেই। বড়ই আফসোস, তা কিন্তু হয়নি।

আমি তাঁকে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়া তাঁর নিজের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না। তিনি মৃত্যুকে মেনে নেবেন, কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবেন না। পরিণতি যাই হোক, তিনি আত্মমর্যাদা বিকাবেন না। এভাবে জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে পারেন এদেশে একালে একমাত্র খালেদা জিয়াই।

তিনিই পারেন নীরবতা দিয়ে সব তুচ্ছ করতে। মৃদুকণ্ঠে জানিয়ে দেয়া ছোট্ট একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি মদমত্ত ক্ষমতার দম্ভকে তাঁর সামনে একটি ধুলিকণায় পরিণত করতে জানেন। হাসপাতালের শয্যায় জীবন-মরণের সন্ধিলগ্নে আবারও তিনি তাই করলেন।

তিনি জানেন, মানুষ হিসেবে ভুলত্রুটি করলেও কোনও অন্যায় বা অপরাধ তিনি করেননি। তিনি জানেন, আজ যারা নিজেদের কব্জায় রেখেছ শাসনকর্তৃত্ব, তারা বর্তমান সময়ের কন্টকাকীর্ণ বাস্তবতা হলেও তাদের নৈতিক বৈধতা নেই। তাদের শাসনের প্রতি জনগণের অনুমোদন নেই। তাই অনৈতিক কর্তৃত্বের কাছে একজন নিরপরাধ মানুষের ক্ষমা প্রার্থনা, মানবতার অপমান।

নতজানু হলে জিয়াউর রহমান ভেতরের-বাইরের কূটচক্রান্তে শহীদ হতেন না। জাতীয় স্বার্থে আপস করলে খালেদা জিয়াই এখন থাকতেন রাষ্ট্রক্ষমতায়। শহীদ জিয়ার জীবনাদর্শ আমরা খুব বেশি অনুসরণ করতে না পারলেও তাঁর আত্মদানকে আমরা সার্থকভাবে রাজনৈতিক পুঁজি করতে পেরেছিলাম। আমার ধারণা আজও আমরা অনেকেই খুশি। খালেদা জিয়া উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর এ দৃঢ়তাই হবে আমাদের মস্ত রাজনৈতিক পুঁজি। কেননা, খালেদা জিয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন মহল এ পর্যন্ত যাই বলেছেন, আর করেছেন তার কোনও কিছুই যুক্তিসংগত নয়, বরং প্রতিহিংসামূলক – এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে।

এখনও সময় আছে, বেগম খালেদা জিয়ার জন্য নয়, নিজেদের ভবিষ্যতের স্বার্থে সবখানে দল ও রাজনীতির সোচ্চার ও সক্রিয় হবার। দায়সারা নয়, সবটুকু আন্তরিকতা উজাড় করে সাহসের সঙ্গে সত্যটা বলবার। বলদর্পী সরকারের জন্য এখনও সময় আছে, তাদের দুর্বিনীত স্পর্ধা প্রশমিত করে সঠিক পথে ফেরার।

মারুফ কামাল খান : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব