লিট ম্যাগজ/ লিটল ম্যাগাজিন বা লি- ম্যাগ যাই বলি না কেন এটি এক কথায় গণ চেতনায় বিপ্লব সৃষ্টির হাতিয়ার। সমকালকে আগামীর পথ দেখানোর সূর্য।

সুতরাং লেখক সম্মানি দেওয়া কোনো তথাকথিত সম্পাদককে পুরস্কার দিয়ে আপনি যদি বলেন, লি-ম্যাগ সম্পাদনার জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, তাহলে আমি বলবো, আপনি ব্যক্তিগতভাবে একজন অসৎ, অশিক্ষিত, অপদার্থ মানুষ এবং কৃষ্টিনাশকারী পুরস্কার দাতা। কারণ, হয় অশিক্ষিত, নয়তো অপদার্থ মানুষ অহেতুক নাম কুড়োতে শিল্প জগতে প্রবেশ করেছেন বলে আপনি জানেনই না লি-ম্যাগ আদতে কী জিনিস, কী এর কার্যক্রম কেমন। নয়ত আপনি ব্যক্তিগতভাবে ভয়াবহরকমের অসৎ মানুষ, যার জন্য কৃষ্টিবিনাশকারী ও আত্ম সুবিধা সন্ধানী, দলবাজ-দলকানা এবং ভোগবাদী স্বভাবী বলেই প্রকৃত মেধাবীকে না খোঁজার মতলবকেই আপনি প্রাধান্য দেন।

লি- ম্যাগ সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক এবং স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। এক কথায় গণজাগরণ মূলক কার্যক্রমের শক্তপোক্ত হাতিয়ার হল লিটলম্যাগ, বা সংক্ষেপে লি-ম্যাগ।

যে সম্পাদক এই অবাণিজ্যিক লি-ম্যাগ কৃষ্টির কৃচ্ছসাধন করে লেখক সম্মানির মূলো ঝুলিয়ে হত-দরিদ্রভিক্ষুক স্বভাব ও অর্থ লিপ্সু মানসিকতার লেখকদের নিয়ে যিনি তথাকথিত লি-ম্যাগ সম্পাদনা ও প্রকাশনা চালায় – তাকে পুরস্কৃত করছেন কী কারণে? এর একমাত্র উত্তর হলো, তার সাথে আপনার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লেনদেন রয়েছে/ টেবিলের তলায় বিনিময় রয়েছে; নয়ত আপনি তার চাচা-মামা কিংবা গডফাদার।

লিট ম্যাগজ গণমানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা, মানবিক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ এবং রাষ্ট্রিক অধিকার আদায়ের লিখিত আন্দোলন, যা কোনোভাবেই সাহিত্য কাগজ বা পত্র হওয়ার নয়। সাহিত্য কাগজ ভিন্ন বিষয়। কিন্তু সাহিত্যেরও বিষয়ে যদি কোনো আন্দোলন-বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা জাগে সেক্ষেত্রে আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে পারে লি-ম্যাগ। যেমন- কোন জনগোষ্ঠীর ভাষাসাহিত্য কৃষ্টি রক্ষা, ভাষার অধিকার, মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষায় পরিণত করার দাবী, বিদেশি সাহিত্যের ঔপনিবেশ অপসরণ ইত্যাদি বিষয়ে গণ আন্দোলন তৈরি, গণ বিপ্লব নির্মাণে লিটল ম্যাগই শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।

যে বিষয়েরই হোক না কেন লি-ম্যাগে আন্দোলন কারীরাই স্বেচ্ছাসেবক লেখক-সম্পাদক ও প্রকাশক হয়ে থাকেন। এতে লেখক সম্মাননার কোনো অজুহাত টিকবে না। কারণ, লেখক সম্মানি যুক্ত হলে তা হবে কর্পোরেট প্রডাকশন। কর্পোরেট প্রডাকশন মানেই তা বাণিজ্যিক, তাতে ব্যবসা হয়; কিন্তু লি-ম্যাগ আদর্শ ও কৃষ্টির বিনাশ ঘটে। সর্বোপরি সেটি কোনো লি-ম্যাগই নয়। লেখক-সাহিত্যিকদের গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশ করা এক জিনিস আর লি-ম্যাগের জন্য গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশ করা ভিন্ন জিনিস।

লি-ম্যাগের গল্প, উপন্যাস, কাব্য, পাঠপ্রতিক্রিয়া, সাক্ষাৎকার সবকিছুরই কেন্দ্রে থাকতে হবে রাজনৈতিক -গণতান্ত্রিক -মানবাধিকার মূল্যবোধ; সমকালীন সঙ্কট চর্চা ও মুক্তির দিশা; বৈশ্বিক বিষয়াবলীকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্যের সাথে তর্কবিতর্ক ও গ্রহণ- বর্জনে সমঝোতার সূচক নির্ধারণ; অবক্ষয় সনাক্ত করণ ও নির্বাণের উপায় অনুসন্ধান ইত্যাদি। এখানে গ্রুপবাজ ও দলকানা বা ব্যক্তিগত খাতিরের কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি সংখ্যাতেই থাকতে হবে একটি বা দুটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গবেষণা ও বার্তা নির্ভর লিখিত সামাজিক আন্দোলন বা জাগরণের হেতু।

লি-ম্যাগ একটি সাম্যবাদী ক্ষেত্র। এতে নারীর ভূমিকা, পুরুষের ভূমিকা নিয়ে গর্ব করারও কিছু নেই। কারণ লি-ম্যাগ সেই মানুষরাই সংগঠিত করেন যারা সমাজের বিপরীত স্রোত ঠেলে ঘুরে দাঁড়ানোর আন্দোলন সংঘটিত করতে সক্ষম এবং নারী-পুরুষ বিভাজনের ঠুনকো মানসিকতা থেকেও বেরিয়ে এসে রাজনৈতিক সচেতন সংগঠক ব্যক্তিত্ব বা গোষ্ঠী।

লি- ম্যাগ কারো ব্যক্তিগত সম্পদ বা প্রডাক্ট না। এটি গোষ্ঠী গত কার্যক্রমের ফসল। অর্থাৎ আপনারা গ্রুপ কনভারসেশন করে একটা কিছু (আইডিয়া) আবিষ্কার করেছেন, যা চলমান সঙ্কট মোকাবেলার জন্য তর্কে বিতর্কে হাতিয়ার হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে- সেটিই আপনাদের লিটল ম্যাগের পরবর্তী সংখ্যার বিষয় হবে। লি-ম্যাগ দলীয় কাজ, একক কোনো কৃতিত্বের ক্ষেত্র নয়। তাই এখানে সম্পাদকের যা ভূমিকা লেখক সহ অন্যান্যদেরও ভূমিকা সমসমান। সম্পাদনার আলাদা কোনো কৃতিত্ব থাকার কথা নেই লি-ম্যাগে। এক গোষ্ঠী বা সংগঠনের নব আবিষ্কৃত চেতনাটি বহু দলীয় গোত্রে বন্টন করে সমাজ-রাষ্ট্র সর্বপরি মানুষের মঙ্গল সাধনা করাই লিট ম্যাগজের একমাত্র উদ্দেশ্য।

যার জন্য লিটল ম্যাগাজিনের সাথে আরেকটি শব্দ সমার্থক অর্থে উচ্চারিত হয়, তা হলো আন্দোলন; অর্থাৎ এর আরেক নাম লিটল ম্যাগ-আন্দোলন। লিট ম্যাগজ বা লি- ম্যাগ তাই বুর্জোয়া, কর্পোরেট, ভোগবাদীদের প্রডাক্ট নয়, লেখক সম্মানি তো দূর কি বাত।

একটি লিটল ম্যাগাজিনের কার্যক্রমকে মূল্যায়ন, মান নির্ধারণ করতে হলে কমপক্ষে পনের বছর পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। কারণ, এর কার্যক্রম সম্পূর্ণ গবেষণামূলক ও বিশ্লেষণ ধর্মী এবং দীর্ঘকালীন ধারাবাহিক কর্মসূচি নির্ভর। কেন মান দিবেন আপনারা, কয়টা সেমিনার করে মান নির্ধারণ হয়েছে- সেসব প্রশ্নের জবাবও থাকতে হবে। তা না হলে আপনাদের পুরস্কারটাই লবিং-গ্রুপবাজির কালিমায় নিম্নমানের হয়ে যাবে। নয় কি! আবার কেউ পুরস্কার দিতে চাইলেই বা আপনারাই বা নিতে যাবেন কেন? কয় বছর বয়স আপনাদের সম্পাদনার? কী কী আন্দোলন সংঘটিত করেছেন এ যাবত? সমাজের কোন কোন স্তরে, কোন কোন শ্রেণি-পেশাজীবী মানুষের কাছে আপনাদের বার্তা সমূহ পৌঁছে দিয়েছেন? ম্যাগাজিনটি না পৌঁছাক কিন্তু আদৌ কি আপনাদের আন্দোলন বার্তাটি সমাজের নীচুতলায় পৌঁছে দিতে পেরেছেন? নাকি বড় বড় কবি লেখক, বড়লোক আর কতিপয় নেতা নেত্রীর ড্রয়িংরুম টেবিল পর্যন্তই পৌঁছে দিয়েছেন? কারণ ওটা বেচে তো আপনাদের প্রকাশনা খরচা তুলতে হয়, নইলে মন্ত্রণালয়ে লবিং করে সরকারি অনুদান হাসিল করারও কায়দা কানুন করতে হয়, নয় কি! এসব নিয়ে ভেবেছেন কি? নাকি শুধু নিজেদের নাম কুড়োতেই ব্যস্ত আপনারা?

বলে রাখি, সরকারি অনুদান হাসিল করাও লিট ম্যাগজ কর্মীদের শোভা পায় না। কারণ এটি অবাণিজ্যিক ও স্বেচ্ছাসেবক কার্যক্রম। সুতরাং সমাজে এসব শ্রেষ্ঠ লিট ম্যাগজ সম্পাদক -সম্মাননা -পুরস্কার প্রাপ্তি হ্যানত্যান প্রতারণা করা বন্ধ করুন। মনে রাখবেন, আপনাদের ওসব ভুগিজুগি সাহিত্য পাতা টাইপ লিট ম্যাগজ ছাড়াও এই সমাজের শক্তি আছে পথ চলার। আপনাদের সম্পাদনা না থাকলেও; আপনারা কেউ পুরস্কার না পেলেও; আপনারা কাউকে পুরস্কার না দিলেও; আপনাদের পুরস্কার কেউ না পেলেও এই সমাজ অন্ধ-অচল-অচেতন হয়ে যাবে না। বরং আপনাদের সংখ্যা বাড়াতেই এই রাষ্ট্র, এই সমাজ আবর্জনা ভরপুর হয়ে উঠেছে।

মুখস্থ কথা চারিদিকে শুনতে পাই, পত্রপত্রিকাতেও ছাপা অক্ষরে দেখতে পাই- লিটল ম্যাগ লেখক তৈরির কারখানা। সেখান থেকেই লেখকরা বিখ্যাত হয়ে যায়। এরচেয়ে ডাহা প্রতারণা আর কী থাকতে পারে! লিটল ম্যাগে লিখতে লিখতে কেউ লেখক হয়েছে বলে আমার জানা নাই। বা কোনো লিটল ম্যাগ আজ পর্যন্ত কোনো লেখক তৈরি করেছে বলেও আমার জানা নাই। লিটল ম্যাগের কোনো দায় নেই লেখক তৈরির করার। সেটিই সার্থক লিটল ম্যাগ যার লেখককর্মীরা তাদের সংঘঠিত আন্দোলন-বিপ্লবকে বিজয়ের পথে নিয়ে গেছেন। তাদের সংগ্রামটিকে গণপ্লাবনে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন বলেই সেই আন্দোলন সফল হওয়ার পরও ইতিহাসে নজীর সৃকরেছেন বলেই সেসব লেখকদের নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান কেড়ে নিয়েছে। সুতরাং লিটল ম্যাগ কারো একক সম্পত্তি যেমন নয়, ঠিক তেমনি কারো একার পক্ষে লিটল ম্যাগ কৃতিত্ব নেওয়াও সম্ভব নয়।

একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে এই বিস্তৃত কথার সমাপ্তি টানছি এবার। আমাদের প্রজন্মের যারা ধারাবাহিক ভাবে ‘উন্মেষ’ পড়েছেন তারা জানবেন, এই লিটল ম্যাগের নামটি মনে এলেই মহসীন শাস্ত্রপাণি, মতিন বৈরাগী ইত্যাদি এক ঝাঁক নাম মগজে এসে উপস্থিত হয়। এতে কে সম্পাদক আর কে লেখক সেটি মনে আসে না। কিন্তু এক দল মুক্ত চেতনা লেখকের পাশাপাশি সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক চেতনা গঠনের মধ্যেই নিমজ্জিত, বামপন্থী রাজনীতি যে জাগরণের সহায়ক -এই বার্তাটি সবার প্রথমে স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। কারণ তাদের (উন্মেষ দলের) বা লেখকদের অথবা পত্রিকাটির উদ্দেশ্যই ছিল এই বার্তাটিকেই নানান ভাবে, লেখনীর নানা বাতারণে পাঠকদের মনে স্প্রেড করা। তাই উন্মেষ মানে একক মহসিন শাস্ত্রপাণি নন; একদল মহসিন শাস্ত্রপাণি অথবা একদল মতিন বৈরাগী একাকার ‘উন্মেষ আন্দোলনে’। আর এই জাতীয় মহসিন শাস্ত্রপাণি বা মতিন বৈরাগীরা সমাজের কোনো পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য লিটল ম্যাগ আন্দোলন করতেন না, বরং তাঁরা একটি চেতনা ধারণ করে সমাজকে সেটিই দেবার জন্য ‘উন্মেষ’ করতেন। আর সেজন্য উন্মেষ মহসিনকে গড়েনি, গড়ে তোলনি মতিনকেও। বরং এই গুণীরাই উন্মেষ গড়েছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব জাগাতে।
ধন্যবাদ।