অনেকে তাদের সমস্যা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে রহস্যময়তার মাঝে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ অবস্থাকে আমরা দ্বিধাগ্রস্ততা, বিষণ্নতা অথবা তুর্কি ভাষায় বলি ‘হুজুন’, যে বিষণ্নতা একান্ত না হয়ে সামষ্টিকও হতে পারে। ‘হুজুন’ আমাদের মাঝে এক ধরনের সান্ত্বনার আবেশ সৃষ্টি করে। শীতের দিনের কেটলির পানি ফুটতে থাকলে নল দিয়ে নির্গত বাষ্প যেমন জানালায় ঘনীভূত হয়, তেমনি ‘হুজুন’ কারও মনকে কোমল করে ফেলে। কেউ জানালার কাছে গিয়ে আঙুল দিয়ে ঝাপসা জানালায় শব্দ লেখে। জানালায় শব্দ বা কোনো কিছু আঁকতে তার ভেতরের ‘হুজুন’ প্রশমিত হয় এবং স্বস্তি অনুভব করে। লেখা ও আঁকাআঁকি শেষ হলে সে হাত দিয়ে সব মুছে ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। কিন্তু কোনো দৃশ্য তার নিজস্ব ‘হুজুন’ আনতে পারে।

তুর্কি শব্দ ‘হুজুন’-এর উৎপত্তি আরবি থেকে। কুরআনের দুটি আয়াতে শব্দটির উল্লেখ রয়েছে ‘হুজুন’ হিসেবে, আর তিনটি আয়াতে আছে ‘হাজেন’ হিসেবে। নবী মুহাম্মদ (স.) তার স্ত্রী খাদিজা ও চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর বছরকে উল্লেখ করেছেন, ‘সেনেততুল হুজন’ অর্থাৎ বিষাদের বছর বলে। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, এই শব্দ দিয়ে গভীর আধ্যাত্মিক ক্ষতির অনুভূতি প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু ‘হুজুন’ যদি একটি ক্ষতি অথবা আধ্যাত্মিক যাতনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়, তাহলে আমার নিজস্ব উপলব্ধি একটি সাধারণ দার্শনিক ত্রুটির দিকনির্দেশ করে, যা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে ইসলামের ইতিহাসের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমরা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ‘হুজুন’-এর আবির্ভাব দেখি, যা দুটি পৃথক দার্শনিক ঐতিহ্যের ধারক। প্রথম ঐতিহ্য অনুসারে আমরা ‘হুজুনের’ অভিজ্ঞতা অর্জন করি যখন আমরা পার্থিব সুখ ভোগ ও বস্তুগত লাভের জন্যে প্রচুর বিনিয়োগ করি, যার মূল অর্থ হচ্ছে ‘তুমি যদি এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে গভীরভাবে সম্পৃক্ত না করে থাকো, তুমি যদি একজন ভালো ও সত্যিকারের মুসলিম হয়ে থাকো তাহলে তোমার পার্থিব ক্ষতির ব্যাপারে তোয়াক্কা করার কোনো কারণ নেই।’

দ্বিতীয় ধারণাটির উদ্ভব সুফিবাদ থেকে, যাতে অত্যন্ত ইতিবাচক ও সহানুভূতিপূর্ণ অর্থ বের করা হয় ‘হুজুন’ শব্দ থেকে এবং ক্ষতির স্থান ও জীবনের দুঃখ বিষাদ সুনির্দিষ্ট করে নির্দেশিত হয়। সুফিদের কাছে ‘হুজুন’ হচ্ছে আমাদের অনুভূত আধ্যাত্মিক মনস্তাপ, কারণ, আমরা এ জগতে আল্লাহর জন্যে যথেষ্ট কিছু করতে পারি না। সুফিবাদের সত্যিকারের একজন অনুসারী মৃত্যুর মতো জাগতিক বিষয়ে কোনো আগ্রহই প্রদর্শন করেন না, ভালো কিছু অথবা পার্থিব অন্যান্য বিষয়ের প্রতি তো আগ্রহের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি যাতনা, শূন্যতা ও অপর্যাপ্ততার শিকারে পরিণত হন, কারণ তিনি কখনো আল্লাহর খুব কাছাকাছি হতে পারেন না। কারণ আল্লাহর জন্যে তার উদ্বেগ যথেষ্ট গভীর নয়। তাছাড়া ‘হুজুন’-এর উপস্থিতি নয়, বরং অনুপস্থিতি তাকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। ‘হুজুন’-এর অভিজ্ঞতা লাভের ক্ষেত্রে ব্যর্থতাই তাকে এর অনুভূতি এনে দেয়, কিন্তু এই যুক্তি অনুসরণ করেই উপসংহারে পৌঁছা যায় যে, ইসলামি সংস্কৃতি ‘হুজুন’কে উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে।

গত শতাব্দীতে ‘হুজুন’ কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা বুঝতে হলে ও এর ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হলে শব্দটির সুফিবাদী অর্থ সম্পর্কে উপলব্ধি করাই যথেষ্ট নয়। বিগত একশ বছর ধরে তুর্কি সংগীতের ক্ষেত্রে ‘হুজুন’-এর আধ্যাত্মিক গুরুত্বকে কাজে লাগাতে হলে ‘হুজুন’ কেন শুধু আধুনিক তুর্কি কবিতার ভাবের ওপরই প্রভাব বিস্তার নয়, বরং এর প্রতীকী অর্থের ওপর এ প্রভাব ফেলেছে এবং দিওয়ানের মতো কবিতার ক্ষেত্রে ‘হুজুন’-এর অতিরিক্ত প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ হয়েছে এবং একটি সাংস্কৃতিক ধারণা হিসেবে পার্থিব ব্যর্থতা, অস্থিরতা ও আধ্যাত্মিক দুঃখের ক্ষেত্রে ‘হুজুন’-এর গুরুত্ব বুঝতে হলে শব্দটির ইতিহাস এবং এর সাথে যে মর্যাদা আমরা যোগ করি শুধু তা জানাই যথেষ্ট নয়। শব্দটির অস্পষ্টতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে আমাদের সেই সব চিন্তাবিদের কাছে ফিরে যেতে হবে, যারা ‘হুজুন’কে কাব্যিক ধারণা অথবা মহিমাময় হিসেবে নয়, বরং অসুস্থতা হিসেবে দেখেছেন। দার্শনিক আল কিন্দির মতে, ‘হুজুন’ প্রিয় কাউকে হারানো অথবা তার মৃত্যুর সাথে জড়িত কিছু নয়, বরং ক্রোধ, প্রেম, বিদ্বেষ অথবা ভিত্তিহীন ভয়ের মতো আধ্যাত্মিক যন্ত্রণার সাথে জড়িত। দার্শনিক-চিকিৎসক ইবনে সিনা ‘হুজুন’কে দেখেছেন একই ধরনের উদার পরিপ্রেক্ষিতে এবং এ কারণে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, অসহায় আবেগের শিকার কোনো যুবকের জন্যে চিকিৎসা হচ্ছে তার নাড়ি পরীক্ষার সময় যুবককে তার প্রেমিকার নাম জিজ্ঞাসা করা। এসব প্রাচীন ইসলামি চিন্তাবিদের নির্দেশিত ব্যবস্থাপত্র রবার্ট বার্টনের হেঁয়ালিপূর্ণ, কিন্তু আনন্দদায়ক সংজ্ঞার অনুরূপ যা সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি উল্লেখ করেছেন তার ‘দি অ্যানাটমি অব মেলানকোলি’ গ্রন্থে। ইবনে সিনার মতোই তিনি ‘কৃষ্ণ দেবতা’কে দেখেছেন মৃত্যুর ভীতি, প্রেম পরাজয়, মন্দ কাজ এবং যেকোনো সংখ্যক পানীয় ও খাদ্যকে, যেগুলো যাতনার সম্ভাব্য কারণ এবং এ থেকে নিরাময়ের পদ্ধতিও অনুরূপ দীর্ঘ চিকিৎসাবিজ্ঞানকে দর্শনশাস্ত্রের সাথে যোগ করে ইবনে সিনা তার পাঠকদের পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তি, কাজ, পরিহার, গুণ, শৃঙ্খলা ও উপবাসের মধ্যে স্বস্তি অন্বেষণ করতে-এই দুটি বিবরণীর মধ্যে ‘হুজুন’ অভিন্ন নির্দেশনার আরেকটি আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ ধরনের সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক ধারা।

অতএব, ধরে নেয়া যায় যে, বিষণ্নতার মতোই ‘কৃষ্ণ বেদনা’ ও ‘হুজুনের’ অনুরূপ বৃন্ত থেকে উৎসারিত রসিকতার ওপর ভিত্তি করে যার উদ্ভব হয়েছে, যে ধারণা প্রথমে এসেছে অ্যারিস্টটলের সময় থেকে এবং আমাদের মাঝে এর একটি সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েছে, যা সাধারণত এই অনুভূতির সাথে এবং সর্বগ্রাসী যাতনার সাথে সংশ্লিষ্ট। এখানেই আমরা শব্দ দুটির মধ্যে অনিবার্য পার্থক্য সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। বরার্ট বার্টন, যিনি বেদনাহত হতে অহংকার বোধ করতেন, তার মাঝে বিশ^াস ছিল যে বিষণ্নতাই সুখী নিঃসঙ্গতার পথ প্রদর্শন করেছে, কারণ এর মাধ্যমেই কল্পনাশক্তি প্রবল হয়েছে এবং সময়ে সময়ে এটি আনন্দদায়ক প্রমাণিত হয়েছে। বিষণ্নতা যদি নিঃসঙ্গতায় পর্যবসিত হয় অথবা বিষণ্নতার কারণেই যদি নিঃসঙ্গতা আসে, তাহলে দুটি ক্ষেত্রেই বার্টন নিঃসঙ্গতাকে দেখেছেন হৃৎপিণ্ড হিসেবে, যা সবকিছুর নির্যাস, বিশেষত বিষণ্নতার ক্ষেত্রে। এর বিপরীতে আল কিন্দি ‘হুজুন’কে দেখেছেন আধ্যাত্মিক একটি অবস্থাকে, যার অনিবার্য লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ এবং এক ধরনের অসুস্থতা হিসেবে নিঃসঙ্গতা কাক্সিক্ষত নয় এবং অনুমোদনযোগ্যও নয়। এসবের কেন্দ্রীয় ধ্যানধারণা, যা প্রাথমিক সকল ইসলামি চিন্তাবিদ পোষণ করে এসেছেন অথবা বিশ^াসীদের সম্প্রদায়ও একই ধারণা পোষণ করেছেন। তিনি ‘হুজুন’কে বিচার করেছেন এর গুণ ও যুক্তি দ্বারা এবং প্রতিকার নিরূপণ করেছেন, যা আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। অতএব, অনিবার্যভাবে তিনি ‘হুজুন’কে দেখেছেন একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে।

আমি উপলব্ধি করতে চাই যে ‘হুজুন’ কোনো নিঃসঙ্গ মানুষের বিষণ্নতা নয়, বরং লাখো মানুষের আচ্ছন্ন মনোভাব। আমি একটি সমগ্র নগরীর ‘হুজুন’ বা বিষণ্নতাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। ‘হুজুন’কে তুলে ধরতে চাইছি যার মাঝে আমরা নিজেদের প্রতিফলিত হতে দেখি, যে ‘হুজুন’কে আমরা একটি সমষ্টি হিসেবে অহংকারের সাথে গ্রহণ করি। এই ‘হুজুন’কে অনুভব করার অর্থ দৃশ্যাবলি দেখা, স্মৃতিকে জাগ্রত করা, যার মাঝে নগরী হয়ে ওঠে ‘হুজুনে’র চিত্র ও নির্যাস। ‘হুজুন’ ও রবার্ট বার্টনের ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতার বিষাদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তা সত্ত্বেও ‘হুজুন’ ও আরেক ধরনের বিষণ্নতার মধ্যে একটি সংশ্লিষ্টতাও আছে যা ক্লদে লেভি-স্ট্রাস বর্ণনা করেছেন যে ‘হুজুন’ একঘেঁয়ে কোনো বেদনা নয়, যা কোনো একজন ব্যক্তির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ‘হুজুন’ সামষ্টিক অনুভূতির সাথে সংশ্লিষ্ট, এ অবস্থা একটি পরিবেশ ও সংস্কৃতি যা লাখ লাখ মানুষের মাঝে ব্যাপ্ত। তুরস্কের রাজনীতি চিন্তায় আত্ম-কলঙ্কের প্রতিধ্বনি, মানুষের জীবনের গুরুত্ব সম্পর্কে সাহসিকতার সাথে কিছু বলার জন্য তুর্কি কবিতায় ‘হুজুন’ এক ধরনের যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটিয়েছে, যা থেকে কারো নিষ্কৃতি লাভ অথবা নিষ্কৃতি লাভের ইচ্ছা ব্যক্ত করাও সম্ভব নয়। কবির জন্যে ‘হুজুন’ হচ্ছে ধোঁয়াচ্ছন্ন জানালা, যে জানালার অস্তিত্ব কবি ও পৃথিবীর মধ্যে। জীবনের ওপর তিনি যে পর্দা ছড়িয়ে দেন সেটি বেদনাদায়ক, কারণ, স্বয়ং জীবনই বেদনাদায়ক। সুফি সাহিত্যের সঙ্গে যে মর্যাদা জড়িত, ‘হুজুন’ তাতে বাড়তি সম্মান এনে দেয়। তুরস্কের ‘হুজুন’ সমাজের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির অবস্থান নেয়ার জন্যে তাগিদ দেয় না, বরং এর বিপরীতে মূল্যবোধ ও সমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তির অবক্ষয়ের কথা বলে এবং সামান্যতে সন্তুষ্ট থাকতে উৎসাহিত করে; সামঞ্জস্য, অভিন্নতা, বিনয়ের গুণকে সম্মানিত করে ‘হুজুন’ দারিদ্র্য ও বঞ্চনার সময়ে সহনশীলতার শিক্ষা নেয় এবং আমাদের নগরীর ইতিহাস ও জীবন পাঠ করতে উৎসাহিত করে।

এমনকি ১৫৮০ সালেও দার্শনিক মন্টেগনি যুক্তি প্রদর্শন করেছেন যে, ক্লান্তিকর বিষণ্নতার মাঝে কোনো আবেগ ও সম্মান নেই। তিনি জানতেন যে তিনি নিজেই বিষাদগ্রস্ত। তাঁর বহু বছর পর ফ্লবার্ট যা বলেছেন, তা মন্টেগনির যুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মন্টেগনি বিষন্নতাকে দেখেছেন আত্মনির্ভর যুক্তি ও ব্যক্তিতন্ত্রবাদের দুশমন হিসেবে। বিষণ্নতাকে তিনি পাগলামি ও আহতাবস্থা এবং সীমাহীন মন্দ কাজের তুল্য মনে করেছেন। মন্টেগনির নিজস্ব দুঃখ বিষাদের মতোই নিঃসঙ্গ ছিল বই নিয়ে একা বাস করে এমন একজন মানুষের মনকে কুরে কুরে খাওয়ার মতো। কিন্তু তুর্কি ‘হুজুন’ এমন কিছু, যার ফলে সমগ্র নগরী নিজেকে এক মনে করে এবং এক বলে স্বীকৃতি দেয়। ঠিক তানপিনারের উপন্যাস ‘পিস’-এর নায়কদের মতো। ইস্তাম্বুলের ওপর লেখা মহান এক উপন্যাস, নগরীর ইতিহাস থেকে উদ্ভূত ‘হুজুন’-এর কারণে নায়কেরা খণ্ডবিখণ্ড ও পরাজিত। ‘হুজুন’-এর কারণেই নির্ধারিত যেকোনো প্রেমের পরিসমাপ্তি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে না।