শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিচালনা বা ম্যানেজমেন্ট বোকা হয়ে ফেল করেছে। এক কথায় ‘ইকোনমিক মিসম্যানেজমেন্ট’-এর কারণে। বাংলায় বলা যায়, অর্থনীতি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক দ্রুটি ও ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে এখানে। আর এতে এর ইমপ্যাক্ট মানে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর যা প্রভাব সেটি কড়া মানসিক আঘাতের পর্যায়ের!

সাধারণ মানুষের জীবন মানেই সবসময় তা একটি স্ট্রাগল; এক নিরন্তর লড়াই। সমাজের যত নিচের বর্গে মানুষে লড়াই ততই যেন নির্মম সে লড়াই। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে এটিই এক প্রধান প্রসঙ্গ! কেন?

মানুষ তার জীবন-সংগ্রামের লড়াইগুলো হাসিমুখেই লড়তে পারে। কিন্তু কেবল এক শর্তে; সেটি হলো এই যে, এই লড়াকু জীবনের একটি শেষ আছে, আশা আছে, ভবিষ্যৎ আছে- এই ইঙ্গিত স্পষ্ট থাকতে হবে। শুধু জীবন-সংগ্রামের আশা আছে, ভবিষ্যৎ আছে- এটুকু দেখতে পেলেও মানুষ সব কষ্টের জীবন বাইতে রাজি থেকে যায়- না থাকলে আত্মহত্যার কথা ভাবে! এমনকি চরম কষ্টের জীবন যার বটম লাইন হলো, নিজ প্রজন্ম তো গেছেই- লড়তে লড়তেই এটি শেষ হয়ে যাবে দেখা যাচ্ছে; মানুষ নিজের সেই জীবন ও প্রজন্মও বাজি ধরে লড়তে লড়তেই শেষ করে ফেলতেও রাজি হয়- কিন্তু কেবল এক শর্তে। সেটি হলো, এই নিজ প্রজন্ম বিলিয়ে দেয়ার বিনিময়ে হলেও যেন তার পরের প্রজন্ম থেকে, মানে নিজ সন্তানদের প্রজন্ম থেকে তাদের যেন আর অন্তত না খেয়ে থাকতে হয়। এই হলো সেই ন্যূনতম আশা; এটিকেই সে নিজ লড়াকু জীবনের ভবিষ্যৎ আছে বলে মানে। ইংরেজিতে এটিকে সাবসিস্টেন্স লেভেল মানে অস্তিত্ব ধরে রাখার লড়াই হিসেবে দেখা হয়; অর্থাৎ ন্যূনতম অস্তিত্ব ধরে থাকতে পারবে, এ নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এটিই সেই প্রণোদনা বা বোঝাবুঝির মৌলিক-বুঝ। নিম্নবর্গের মানুষকে এ নিশ্চয়তাটুকু দিতে হয়, এই আশার বাতিটুকু যেন না নিভিয়ে দেয়া হয় সে দিকে রাজনীতি ও সরকারকে খেয়াল রাখতে হয়- এটিই এ থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ। সেটিই ন্যূনতম বুদ্ধিমান সরকার যে এ দিকটি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল এবং বাস্তব বোধবুদ্ধিসম্পন্ন!
দুঃখের বিষয়, শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার সরকার এই ন্যূনতম যোগ্যতা নিজে হারিয়েছে, আর এতে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষকেও তাদের নিজ নিজ জীবন সম্পর্কে পুরোপুরি হতাশ করেছে। বেঁচে থেকে জীবন সংগ্রামের সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। এ নিয়ে বিবিসির এই শিরোনাম এক টিনএজ তরুণী বলছে, ‘আমি অল্পবয়সী তবু এখন এখানে আমি আমার ভবিষ্যৎ দেখি না।’ অথবা রান্নার গ্যাসের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়ানো মানুষ হঠাৎ আর্তনাদ করে বলছে, ‘একমাত্র আল্লাহই আমাদের চাইলে বাঁচাতে পারে।’ এসবই হলো, আশার বাতি নিভিয়ে দেয়া জীবনের খেদোক্তি।

এই হলো এখনকার শ্রীলঙ্কান জীবনের সাধারণ ও কঠোর বাস্তবতা! গত সোমবার ৯ মে এর সারা দিনে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত গণসন্তোষ-বিক্ষোভে এক সিটিং সরকারি এমপিসহ মোট আটজন নিহত হলেন। সিএনএনের ভাষ্যমতে, স্থানীয় লাইভ টেলিভিশনে দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে যে, ‘সরকারি দলের সংগঠিত গুণ্ডারা লাঠিসোটা আর বুলেটের অস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর রাজধানীর কয়েকটি স্থানে প্রথমে চড়াও হয়েছিল। সরকারের অনুমান, এসব বিক্ষোভ শক্তহাতে দমন না করে সামলালে তাদের জন্য বিপদ হবে। কিন্তু এতেই ঘটনা ঘটে উল্টা অর্থাৎ সরকার যে মানুষের জীবনের সব আশা কেড়ে নিয়েছে, এসব দিকে সরকারের খেয়াল ছিল না। আর এতেই আরো বিক্ষোভে ফেটে পড়া মানুষেরা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি নেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে হামলা করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজ বাসা ছেড়ে এক নৌঘাঁটিতে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। আর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে জনগণের ক্ষোভ প্রশমনের করার চেষ্টা করেন।

তামিল-সিংহলি
এ দিকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে এক বড় দীর্ঘ দিনের অসন্তোষের জায়গা হলো, প্রধান এথনিক জনগোষ্ঠী সিংহলিদের সাথে জনসংখ্যার প্রায় ১৩ ভাগ তামিল এথনিক জনগোষ্ঠী যারা মূলত শ্রীলঙ্কার উত্তরে ও পুবে বসবাস করে। মনে করা হয়, ব্রিটিশ আমলে এরা চাবাগান ইত্যাদিতে অগ্রসর ও দক্ষ শ্রমিক বলে তাদের ভারতের তামিলনাড়– থেকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করলেও তামিলনাড়–র তামিলরা স্থায়ী হয়ে শ্রীলঙ্কায় থেকে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে সিংহলিদের সাথে চেয়ে তামিলদের নাগরিকবৈষম্য বেড়ে গেলে সশস্ত্র এলটিটিই গোষ্ঠীর জন্ম হয়। কিন্তু লম্বা ৩৫ বছরেও কোনো আপস-সমাধান না আসায় বা অনেকের চোখে এ আন্দোলন সশস্ত্রতাতেই থেকে যাওয়ার আগ্রহ সীমাহীন ছিল বলে এটি কোনো সমাধানের চেয়ে সঙ্ঘাত চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত তৈরি করেছিল। ফলাফলে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনী সশস্ত্র বলপ্রয়োগে আক্রমণ শুরু করলে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী ছারখার হয়ে যায়। আর সেটি ছিল মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকারের আমল। তাই অনেক মনে করেন, সেই থেকে জাতিবাদী বীরের অহং তৈরি হয়েছিল রাজাপাকসের পরিবারকে কেন্দ্র করে। যেমন এখন যিনি শ্রীলঙ্কা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে তিনি পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর আপন ছোট ভাই। এভাবে ২০১৯ সাল থেকে চলে আসা গোতাবায়া সরকারে রাজাপাকসে পরিবারের অন্তত ২০ জন সদস্য মন্ত্রী বা এমপি হয়ে নানা পদে জড়িয়ে ছিলেন। সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কান রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের প্রভাব অনেক বেশি, তা অনুমান করা কঠিন নয়; যদিও এ দিকের বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবিসির শিরোনাম : শ্রীলঙ্কার সঙ্কট : যুদ্ধবিজয়ী বীরেরা কী করে ভিলেন হয়ে গেলেন?

এখান থেকে আরেকটু অনুসিদ্ধান্ত টানা যাক। গত ৯ মে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা পদত্যাগ করার পরে আগেই ওঠা প্রেসিডেন্ট ও ছোট ভাই গোতাবায়ার পদত্যাগের পাবলিক ডিম্যান্ড বা দাবি এখন আরো জোরদার হয়েছে। এরই মধ্যে গোতাবায়া তাদের দলীয়, আগে পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে গেছে। তাই তিনি পাবলিকের কাছে আহŸান রেখেছেন ‘ধৈর্য ধরতে, তিনি সব কিছু ভালো জায়গায় ফিরিয়ে আনবেন।’ কিন্তু তিনি কি সেই সুযোগ পাবেন?
ওই সাক্ষাৎকারে তিনি কোনো আশা জাগাতে পারেননি। নিজেই এমন শঙ্কা ব্যক্তও করেছেন। বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক অবস্থা আবার ভালো হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই না আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়।’ এরই প্রতিধ্বনি যেন পাবলিক ডিম্যান্ডে যে গোতাবায়াকেও পদত্যাগ করতে হবে।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বাস্তব অবস্থাটা কী
এক কথায় এর জবাব, এই অর্থনীতির এক ব্যাপক সংস্কার করতে হবে এবং কমবেশি সবাই মানে যে, আইএমএফের হাতেই এই সংস্কার হলেই ভালো। অনেক এটিকে ঋণ গ্রহণের সাথে পরিশোধেরও কাঠামোতে বদল আনা বলছেন। এক পেছনে মূল কারণ হলো, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (প্রধান পণ্য উৎপাদন চা-সহ) কোম্পানিগুলোর বড় একটি অংশ বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানায়। মানে পুরানা দিন থেকেই স্থানীয় ব্যবসায় বিদেশী নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। সোজা কথায় এতে অর্থনীতিতে প্রডাকটিভ ক্যাপিটালের চেয়ে বিনিয়োগ ক্যাপিটালের ভ‚মিকাটার প্রভাব অনেক বেশি। এ ছাড়া এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরেক বড় ফ্যাক্টর!

সভরেন বন্ড
ইংরেজি সভরেন শব্দের আক্ষরিক অর্থ সার্বভৌম। কিন্তু অর্থনীতিতে সভরেন শব্দ ব্যবহার হয় একটু ভিন্ন অর্থে। এখানে সভরেন মানে ‘রাষ্ট্র নিজে গ্যারান্টি দিচ্ছে’ এ ধরনের। কিন্তু ঠিক কিসের গ্যারান্টি? সে প্রসঙ্গে যাবো।
এ দিকে ‘বন্ড’ বলতে তা সরকারি সিল-ছাপ্পড় মারা এক কাগুজে নোট লিখে দেয়া ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু সভরেন বন্ড, একসাথে এ কথার মানে হলো, কেউ নিজ অর্থ দিয়ে কোনো রাষ্ট্রের সভরেন বন্ড কিনতে পারে। এর বিশেষত্ব হলো এর ম্যাচুরিটি মানে পাঁচ বছরের বন্ড হলে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়া শেষে এর সুদসহ আসল অর্থটা ওই রাষ্ট্র বন্ড ক্রেতাকে ফেরত দেবে বলে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে। আর স্বভাবতই অপর কোনো ব্যক্তি বা প্রাইভেট কোম্পানির ইস্যু ও বিক্রি করা বন্ডে দেয়া গ্যারান্টির চেয়ে খোদ রাষ্ট্রের নিজের দেয়া গ্যারান্টির ওজন ও আস্থা পাবলিকের কাছে অনেক বেশিই হবে।

এই বিচারে কোনো সরকারের ইস্যু করা ‘ডলার সভরেন বন্ড’ (ইন্টারন্যাশনাল সভরেন বন্ড-আইএসবি) মানে, বৈধ আমেরিকান ডলার খরচ করে যে বন্ড কিনতে হয়- এমন বন্ড ছেড়ে সরকার নিজ প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড়ের এই সহজ উপায় বলে একালে মনে করা হয়। এটি আমেরিকার মতো বড় ও প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতির বেলায় গ্লোবাল পুঁজিবাজারে যথেষ্ট আস্থাবাচক- এক বন্ড কেনা ও বেচার ব্যবস্থা। তা বোঝা যায়। যেমন আমেরিকার এমন এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের সভরেন বন্ড এখনো কিনে রেখেছে চীন ও জাপান। কিন্তু বলাবাহুল্য বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার সরকার যদি অমন সভরেন বন্ড ইস্যু করে থাকে তবে তা একই আস্থাবাচক হবে না।

তবে বাংলাদেশের কখনোই এমন সভরেন বন্ড ইস্যু বা চালু করেছে বলে জানা নেই যদিও চলতি সরকারের আমলেই এমন কিছু বিক্ষিপ্ত আলোচনা উঠেছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সভরেন বন্ড ইস্যু করা আছে। আর শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রধান কারণ বলে, অনেক ইন্ডিপেনডেন্ট রিপোর্ট বা সিএনএন, বিবিসিসহ শ্রীলঙ্কার স্থানীয় মিডিয়াতেই মানা হয় যে, শ্রীলঙ্কান সভরেন বন্ডের সর্বশেষ সুদ ফেরত দেয়ার তারিখ ছিল গত ১২ এপ্রিল ২০২২। সরকার নিজেই বিবৃতি দিয়ে এই অর্থ ফেরত দিতে রেডি নয় বলে অপারগতা জানায়। আর তখন থেকে গ্লোবাল বাজারে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ও সরকার ডুবে যাচ্ছে এ খবর আর লুকানো না থেকে চাউর হয়ে যায়। তবে এসব কথা কেবল গত এপ্রিলের নয়। এর আগে ফেব্রæয়ারি মাসেও একইভাবে (আইএসবি) পাওনা পরিশোধ করতে শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। এবার এপ্রিলে আরো বলা হয়েছিল জরুরি খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধ ইত্যাদি আমদানির অর্থ না থাকাতে তারা তখনই আর নিজ বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডার খালি করতে চাইছে না। কিন্তু কার্যত এটি দাঁড়িয়েছে যে, সরকার আইএসবি বন্ডের পাওনা শোধ করেনি আবার প্রয়োজনীয় জরুরি দ্রব্যাদিও সব আমদানি করতে পারেনি। ফলে জ্বালানি তেল, জ্বালানি গ্যাস ও খাদ্যশস্য এমনকি স্কুলের পড়ালেখার কাগজও আমদানি করতে পারেনি বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে। আর এ থেকেই সেটি শ্রীলঙ্কার সমাজ ও অর্থনীতিতে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠার অবস্থা সৃষ্টি করেছিল।

বৈদেশিক বন্ড বা আইএসবি প্রসঙ্গে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা। অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক বা চীনা বা অন্য কোনো দেশের ঋণ নেয়ার চেয়ে আইএসবি ইস্যু করে গ্লোবাল পুঁজিবাজার থেকে ডলার জোগাড় করলে কোনটি ভালো বা দুটোর ভালো-মন্দ কী? বিশেষজ্ঞরা আমাদের মতো দেশের বেলায় বন্ড বা আইএসবি ইস্যু করাকে নিরুৎসাহিত করে থাকে, তুলনায় অবকাঠামো (বিশ্বব্যাংক বা চীনের মতো দেশ) ঋণ নেয়াকে ভালো মনে করে। এর পেছনের কারণ বলা হয়, অবকাঠামো প্রকল্প বাজেটের যেসব অর্থ অন্তত স্থানীয়ভাবে কিনতে বা ব্যয় করতে হবে যেমন স্থানীয় শ্রম কিনতে বা সিমেন্ট বা রড ধরনের কাঁচামাল ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য বা প্রকল্পের জমির মূল্য পরিশোধ- এসবের তুল্য সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়ে ওই প্রকল্প স্থানীয় মুদ্রা নিজ অ্যাকাউন্টে জমা করে নেয়। এতে এই বৈদেশিক মুদ্রা রাষ্ট্রের আয় হিসেবে গণ্য করার সুযোগ হয়। আর তুলনায় বন্ড-আইএসবি ইস্যু করে বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড় করলে তা সুদসহ আসল, সবটাই ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে বন্ড-আইএসবি ইস্যুর চেয়ে বৈদেশিক ঋণ প্রকল্প উৎসাহের বিষয় বলে গণ্য করা হয়। দেখা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কা এসব বাছবিচার বিবেচনাকে আমল না করে এগিয়ে চলতে গিয়ে আজ বিপদে।

সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতিতে এ থেকে উদ্ধার পেতে গেলে সেই সমাধানের ওপর গ্লোবাল বাজারের ওই রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর আস্থা থাকাটাও খুবই জরুরি মনে করা হয়। যেমন গত ফেব্রæয়ারি থেকেই অর্থনৈতিক রেটিংয়ের ইন্ডিপেন্ডেন্ট, এমন অন্তত দু’টি প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে খারাপ রেটিং দেয় বা রেটিং নামিয়ে দিয়েছিল। এর সোজা ফলাফল হলো, বিদেশীরা এই রেটিং দেখেই কিন্তু বন্ড-আইএসবি বা কোনো দেশীয় প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচা করতে আসে। এসব কারণে, যখন গ্লোবাল বাজার দেখে যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটে ফাইনালি আইএমএফ এসে ওই দেশকে উদ্ধারের জন্য কাজ শুরু করছে এটিই (গ্লোবাল বাজারে) সবার কাছে এক আস্থার চিহ্ন ছড়িয়ে দেয়। অতএব, সে কারণেই সবাই এখন তাকিয়ে আছে আইএমএফের সাথে শ্রীলঙ্কা সরকারের যে কথা-নেগোশিয়েশন চলছে গত ফেব্রæয়ারি থেকে, তা কবে দ্রæত চুক্তিতে সম্পন্ন হয়। আর অর্থনীতি উদ্ধারে আইএমএফ তার কাজ শুরু করে!

এসবের মধ্যে আরেক বড় জটিলতা হলো, দেশের রাজনৈতিক অবস্থায় বোঝাই যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াকেও পদত্যাগ বিনা স্থিরতা আসছে না। যার অর্থ আইএমএফ তা হলে কি নতুন নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করবে? সোজা কথা, গোতাবায়া যতই নিজের পদত্যাগে দেরি করবেন ততই আইএমএফ সংস্কার কাজে নামতে দেরি করবে! অথচ ঘটনা সে দিকেই যাচ্ছে। এক দিকে বাজারে খবর হলো, নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিলকে গোতাবায়ার লোক মনে করা হয়। অর্থাৎ আস্থা নেই। ফলে এদের সবার পদত্যাগ না দেখলে নয়া রাজনৈতিক ঐক্য আনা ও সংস্কার কার্যকর করতে এগিয়ে আসা সব পিছিয়ে যেতে থাকবে।

চীনবিরোধী প্রপাগান্ডার কী খবর
শ্রীলঙ্কা নিয়ে যেসব সিরিয়াস মিডিয়া রিপোর্ট করছে এদের মধ্যে যেমন ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বা বিজনেস স্টান্ডার্ড আছে- সব মিলিয়ে কেউই এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্য শ্রীলঙ্কা ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ পড়েছে বলে প্রপাগান্ডা করেনি; বরং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস স্পষ্ট করে জানাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার নেয়া মোট বৈদেশিক ঋণের (সেটি ৫১ বিলিয়ন ডলার বলে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে) মধ্যে মাত্র ১২.৫৫ বিলিয়ন ডলারের হলো বন্ড-আইএসবি ইস্যু করে নেয়া বৈদেশিক ঋণ। যদিও টাইমস অব ইন্ডিয়া পরোক্ষে এমন মানে করে রেখেছে যেন এই ৫১ বিলিয়ন ডলারের পুরোটার ওপর কিস্তি না দেয়ার জন্যই যেন শ্রীলঙ্কার ক্রাইসিস। এ কথা সত্য নয়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, বন্ডের ক্রেতার দায় মাত্র ১২.৫৫ বিলিয়ন ডলারের আর এসব বন্ড যারা কিনেছে এরা হলো প্রধানত জাপান, চীন ও এডিবি সাথে কিছু খুচরা বিনিয়োগকারী।

এর সোজা মানে হলো, চীনের কোনো ঋণ-গছিয়ে দেয়ার ফাঁদে পড়ার গল্প এটি নয়। এটি সোজাসাপ্টা বন্ড-আইএসবি ইস্যু করার বোকামি এবং বন্ড ক্রেতাদের কিস্তির অর্থ পরিশোধে ব্যর্থতায় বাজারে খারাপ ইমেজ আর খারাপ অর্থনীতি আর তা মিস-ম্যানেজ বা ভুল পরিচালনাজনিত সমস্যা।

কিন্তু তবুও ভারতেরই আরেক দল মিডিয়া (যেমন টাইমস অব ইন্ডিয়া) এটিকে চীনের ঋণ-গছিয়ে দেয়ার ফাঁদ বলে পুরোনা স্টাইলের প্রপাগান্ডার মধ্যে এখনো আছে ও চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ভারতের আইপি টিভি (প্রথম কলকাতা) বা সোশ্যাল মিডিয়া টিভি অথবা ফেসবুক ধরনের সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি, এসব জায়গায় গেঁথে বসা প্রপাগান্ডা ধারণাটা হলো, চীনা ঋণের কারণেই শ্রীলঙ্কা অর্থনীতির আজ এ দুর্গতি। অথচ এটি ভিত্তিহীন। আর সবচেয়ে বড় কথা, ওই হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দরের মালিকই এখন আর শ্রীলঙ্কা সরকার নয়। তাই ওটা নির্মাণের ব্যয় পরিশোধের কোনো দায় বা ঋণের বোঝা শ্রীলঙ্কান সরকারের নয়। সোজা কথায়, বন্দরের মালিক শ্রীলঙ্কা সরকার নয়। ওর মালিক এখন চীনের এক প্রাইভেট কোম্পানি যারা বন্দর চালিয়ে নিজের আয় থেকে দায় তুলে নেবে ও নিচ্ছে। ফলে ওই বন্দর নির্মাণ খাতের কোনো ঋণ শ্রীলঙ্কা সরকারের নেই; ওই বালাই-ই নেই এই হলো বাস্তবতা!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক