বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন সফররত দুই মার্কিন কংগ্রেসম্যান। আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কোনো পথ আছে কিনা সেই জিজ্ঞাসাও ছিল তাদের। পাশাপাশি তারা জানতে চেয়েছেন, আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হতে পারে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, নির্বাচন আয়োজন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করেন তারা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠক হয় মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের। এ সময় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ উঠে আসে; নির্বাচনকালীন পরিবেশ নিয়েও আলাপ হয়।

গতকাল দুপুরে প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে বৈঠক করেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান এড কেইস ও রিচার্ড ম্যাকরমিক। তারা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চান। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, বৈঠকে তারা জানতে চেয়েছেন, সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার কোনো পথ আছে কিনা। মন্ত্রী বলেন, আমরা জানিয়েছি বিএনপির যে দাবি সরকারের পদত্যাগ, সেক্ষেত্রে সমঝোতার সুযোগ নেই। আমি পাল্টা প্রশ্ন রেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের আগে সরকার পদত্যাগ করে কিনা?

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার বিষয়ে কোনো বার্তা দিয়েছেন কিনা কংগ্রেসম্যানরা এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, রিপাবলিকান একজন বললেন, আমরা সবসময় সমঝোতায় যাই। আমরা বলেছি, সমঝোতা করার মতো দাবি-দাওয়া তো এখানে নেই। আমরা চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আমাদের উল্টা দল (বিএনপি) তো নির্বাচনের খবরই রাখে না। তারা চায় সরকারের পতন। সরকার পতনের ইস্যু সংলাপে যাওয়ার মতো কোনো টপিক নয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা (কংগ্রেসম্যানরা) নির্বাচনের কথা বলেছেন। আমরা বললাম, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নিজের তাগিদে আমরা একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই। এটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীও অঙ্গীকার করেছেন। কারণ আমরা জনগণের সমর্থনে আছি। আওয়ামী লীগ সবসময় নির্বাচনে বিশ্বাস করে, নির্বাচনমুখী দল। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা থাকলে সুষ্ঠু এবং সহিংসতা ছাড়া নির্বাচন সম্ভব।

তিনি বলেন, যতগুলো দল আছে সব দল যদি নির্বাচনে যোগদান করে; তারা যদি আন্তরিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়; অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতা ছাড়া নির্বাচন চায় তাহলে নির্বাচন সহিংসতা ছাড়া হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা বলেছি, এখানে নির্বাচন তোমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) ওখানকার চেয়ে ভালো হয়। তোমাদের ওখানে লোকে ভোট দেয় না। আমাদের এখানে অধিকাংশ লোক ভোট দেয়। তোমাদের ওখানে লোক নির্বাচনে দাঁড়ায় না। এখানে একটা নির্বাচনে কয়েকশ লোক দাঁড়ায়। ওটা নিয়ে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই।

বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে কিনা জানতে চেয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান এড কেইস ও রিচার্ড ম্যাকরমিক। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, আমরা চীনা ঋণের ফাঁদে যাচ্ছি না।
সাংবাদিকরা জানতে চান, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক সমস্যা নিয়ে কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে? আলোচনায় চীনের প্রসঙ্গ এসেছে কিনা?

জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,ওদের কাছে বিভিন্ন লোকজন বলেছে, বাংলাদেশ একটা ভয়ংকর জায়গা। এরা চীনের খপ্পরে পড়ে গেছে। চীনের গোলাম হয়ে গেছে।

মন্ত্রী বলেন, চীন নিয়ে তারা (কংগ্রেসম্যানরা) বলেছে, তোমরা চীনের ভেতরে চলে যাচ্ছ। আমরা বলেছি, আমরা চীন থেকে ঋণ নিয়েছি এক পার্সেন্টের মতো। এটা কোনো বড় ইস্যু না। মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা অবাধ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।

ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ে মোমেন বলেন, আলোচনা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে যে আউটলুক তৈরি করেছি, সেটা বলেছি। আমরা চাই ফ্রি, ফেয়ার, ইনক্লুসিভ ও সিকিউরড ইন্দো-প্যাসিফিক। ফ্রি নেভিগেশন চাই। সবাই সমৃদ্ধ হবে, এমন ইন্দো-প্যাসিফিক আমরা চাই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় দুই কংগ্রেসম্যান বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পক্ষে শরীয়তপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তামান্না নুসরাত বুবলি, বিএনপির পক্ষ থেকে দলের প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও জাতীয় পার্টির পক্ষে দলটির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির সভাপতি শেরিফা কাদের ও জাতীয় পার্টি সমর্থিত নীলফামারী-৩ আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব) রানা মোহাম্মদ সোহেল আলোচনায় অংশ নেন।

সূত্র জানায়, তিন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এক টেবিলে আলোচনায় বসেন। সেখানে প্রত্যেকেই তাদের দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা জানান, সংবিধান অনুযায়ী সরকার ও আওয়ামী লীগ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। সেটি শুধু কথার কথা নয়, আমরা করে দেখাব। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে বাধা ও সহিংসতা চায় না, আমরাও চাই না। আওয়ামী লীগের তরফে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার যে সুযোগ নেই, সেটিও স্পষ্ট করা হয়। অন্যদিকে ন্যূনতম কী পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সে আলোচনায় দলটির প্রতিনিধি জানান, অবশ্যই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এ ছাড়া বৈঠকে সাবেক সংসদ সদস্য এ্যানি বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক মামলা দিয়ে হয়রানি, রাজনৈতিক মামলায় নেতাকর্মীদের সাজা, আগামী নির্বাচন ও নির্বাচনের বর্তমান পরিবেশের বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন বলে জানা গেছে। ২৮ জুলাই ঢাকার মহাসমাবেশ ও ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলা, কর্মসূচি ঘিরে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের বিষয়টিও তুলে ধরেন বিএনপির এই নেতা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেন তিনি। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দেন।

বৈঠকে এ্যানি নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। ২০১৪ সালে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সে নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে যায়নি। ২০১৮ সালে আগের রাতে ভোট হয়ে গেছে। নির্বাচনের আগে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের ওপর হামলা হয়েছে।

এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয় দুই কংগ্রেসম্যানের। পিটার হাসের বাসা থেকে বেরিয়ে আলোকচিত্র শিল্পী, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী শহীদুল আলম বলেন, ঘরোয়া আলাপ ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে অনেকে কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মানুষ নির্যাতিত, সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি সেসব কথা উঠেছে। আমাকে যে আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তা নিয়ে এখনো আমি ভুগছি, আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে।
বৈঠকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে আর্টিকেল ১৯-এর আঞ্চলিক পরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া) ফারুক ফয়সাল বলেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করার লক্ষ্যে কী করা দরকার সেসব বিষয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে। তারা জিজ্ঞাসা করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল কি-না। আমরা বলেছি বাংলাদেশে আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, এখন নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না, সেটা রাজনৈতিক দল বলতে পারবে বলে জানিয়েছি। নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানে সব রাজনৈতিক দলের সংলাপ প্রয়োজন বলে মনে করেন ফারুক ফয়সাল।