আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা
বাংলাদেশের ৪৩ বছরে গণতন্ত্রের উঠতি-পড়তি খুব কম নয়। মূলধারাটি নিশ্চিতভাবে গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এরশাদ আমলে দীর্ঘ সংগ্রামের পর এখানে নতুন করে গণতন্ত্রের বীজ বপিত হয়েছিল। মূল দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে একসঙ্গে মিলে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনটি টার্মে পরাজিত দলের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হলেও মানুষ সংসদের তিনটি নির্বাচন মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সে যাত্রা শুরু থেকে সংসদ বর্জনের মতো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরিচালিত হতে শুরু করে বিরোধী দল। এটি একটি নৈতিক-রাজনৈতিক লড়াই ছিল। বিজয়ীরা সব দখল করে নেয়। তারা পরাজিতদের বিজিত মনে করে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়, যেন তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এটি একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা, যা আমাদের দেশে শুরু থেকে ছিল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হওয়া উচিত। কিন্তু সে আন্দোলন মানে কি লাগাতার সংসদ বর্জন? তাহলে তো সংসদ থাকে না। বিরোধী দলবিহীন সংসদের অধিবেশনগুলো হয়ে যায় অর্থহীন। এভাবে শেষ পর্যন্ত সংসদও অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই বোধ ও উপলব্ধি সরকার-বিরোধী দল নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকতে হবে। এই বোধটিকে আমি একটি রাজনৈতিক নীতিবোধও বলছি। এটি অনুপস্থিত থাকলে তা গড়ে তোলার জন্য যে লড়াই, সে লড়াইকে আমি একটি রাজনৈতিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই বলছি। রাজনৈতিক দলগুলো এ লড়াই করছে না, আমরা নাগরিক সমাজকে এ লড়াই করতে দেখেছি। যার মধ্যে আবার ছাত্রসমাজ অন্তর্ভুক্ত নয়। আমাদের সমাজে শিক্ষার হার ও মান এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিবেচনায় ছাত্রসমাজ হলো গণতন্ত্রের ভ্যানগার্ড। আমি মনে করি, ছাত্ররাই পারে এ লড়াইকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু ছাত্ররা কি পারছে? পারছে না। তার কারণ আমি এর আগে বলেছি। খুবই মনোযোগের সঙ্গে শাসক দল ছাত্রদের তাদের লেজুড় বানিয়ে রেখেছে। ছাত্রদের এ লেজুড়বৃত্তি ভাঙতে হবে।
আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা
পরিস্থিতির এত অবনতি হয়েছে যে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন দল ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নেওয়ার চেষ্টা করছে। বিরোধী দল নৈতিক জায়গা তৈরি করতে পারেনি বলে তাকে চ্যালেঞ্জও করতে পারছে না। মুখে মুখে চ্যালেঞ্জ করছে তারা, কিন্তু কার্যকর কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারছে না। ছাত্ররা কি পারবে এ অচলায়তন ভেঙে ফেলতে? আমি বলতে চাই, পারবে। তাদের পারতে হবে। আর এ জন্য শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সাম্প্রতিককালে ছাত্রদের যত আন্দোলন আমরা দেখেছি, তার সব কটিতেই সরকারি ছাত্রসংগঠনের বাধা প্রদান খুব স্পষ্ট। আর বিরোধী ছাত্রসংগঠন একেবারে অনুপস্থিত। আন্দোলন গড়ে তোলার পদক্ষেপও তাদের নেই। এর আগে আমি প্রাসঙ্গিকভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের উদাহরণ দিয়েছিলাম। এখন আরো দু-তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই।
১ এপ্রিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে ছাত্রলীগের নেতা সাদ নিহত হওয়ার পর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের বীভৎস, ভয়ংকর রূপটি সবার সামনে চলে আসে। প্রথম দিকে হত্যাকাণ্ডের দায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু সাদ নিজে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে বলে যায়, ছাত্রলীগের কর্মীরাই তার ওপর হামলা করেছে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ করে ছাত্রীরা সাদ হত্যার বিচারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। বিশেষ করে ছাত্রীরা কেন? এ ব্যাপারে কৌতূহলী মানুষ জানতে পারে, ছাত্রলীগের বড় একটি অংশ ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত, অশ্লীল কথাবার্তা বলত, ভয় দেখাত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছে, তারা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। হলে হলে নির্যাতন সেল, ক্যাম্পাসের আশপাশের দোকানে চাঁদাবাজি, হলে ছাত্র ওঠানোসহ অনেক নেতিবাচক কাজের অভিযোগ তুলেছে তারা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে টর্চার সেল (!) ভাবা যায়? কিন্তু তাই ছিল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের অভিযোগ, তারা কর্তৃপক্ষকে, বিশেষ করে প্রক্টরকে এসব ব্যাপারে জানিয়েছে। কিন্তু তিনি নিজে ছাত্রলীগের লেজুড় একজন। তিনি বলছেন, কোনো হল প্রশাসন আমাকে বিষয়টি জানায়নি। কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ ছাড়া আমি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না।
ভাবা যায়? জিজ্ঞাসা করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জানায়, এ ধরনের কোনো অভিযোগ করলে প্রক্টর সেটি ছাত্রলীগের নেতাদের বলে দেন। ফলে অভিযোগকারী অধিকতর নির্যাতনের শিকার হয়। এসব কথা কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সরকার জানত না? আগে না জানলেও এখনো কি জানে না? কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও কি নারায়ণগঞ্জের মতো হয়ে গেল? অথচ দোষ দেওয়া হচ্ছে সাধারণ ছাত্রদের যে তারা আন্দোলন করে না। কত বড় ভণ্ডামি!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম টর্চার সেল চালু আছে বলে শুনিনি। কিন্তু সেখানে ছাত্র আন্দোলনের ওপর নির্যাতন করতে দেখলাম ছাত্রলীগকে। তা-ও আবার পুলিশের সহযোগিতায়। সান্ধ্য কোর্স চালু ও তাতে টাকার বিনিময়ে ভর্তি হওয়ার যে পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চালু করেছিল, তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রসমাজ। এ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাতের কোর্সে যারা ভর্তি হবে, তাদের মেধা তুলনামূলকভাবে কম হলেও প্রয়োজনীয় টাকা দিতে পারলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ টাকা থাকলে যেকোনো মেধা নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুযোগ ধনীদের জন্য খোলা থাকবে। তার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করবেই।
একটি অভিযোগ উঠেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই নিজেদের শ্যালক, জামাই, পুত্রবধূকে চাকরি দিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিয়োগ কার্যকর করেছিল। বর্ধিত জনবলের যথার্থতা পূরণ করার জন্য তারা নৈশ কোর্স চালু করেছিল এবং এ জন্য ছাত্রদের বেতনসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রে ফি বহুগুণ বৃদ্ধি করেছিল।
ছাত্রদের উত্থাপিত এসব অভিযোগ কি সত্যি ছিল? নিশ্চয়ই। এর পাল্টা কোনো জবাব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত দেয়নি। ছাত্ররা যখন এ অন্যায়ের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছিল, আন্দোলন জোরদার হয়েছিল, তখন ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা চালায় এ অভিযোগ তুলে যে এ আন্দোলন ছাত্রশিবিরের। ঠিক যেমনটি তারা করেছিল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তারও আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায়।
ছাত্রদের এ প্রবণতার বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হবে। সরকারের প্রবণতা যা সব জায়গায় জামায়াত-শিবির জুজুর ভয় দেখায়। এটা এখন তাদের বোঝা দরকার, সরকারি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে মিলে তারা কোনো আন্দোলনকে সফলতার দরজায় নিতে পারবে না। গণজাগরণ মঞ্চ ছাত্রদের মঞ্চ নয়। এটি একটি নতুন প্রজন্মের মঞ্চ, যার মধ্যে ছাত্রদের ভূমিকাই বেশি। সে গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে গেছে কোনো যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছার আগেই। আর এসব আন্দোলনের কোনোটিতে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের অংশগ্রহণ নেই। তারা নিজেরাও আলাদা কোনো ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে না।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীনরা কেবল ছাত্রদের আন্দোলন রোখার লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও নিজেদের কবজায় রাখার চেষ্টা করছে। এ জন্য ঢাবি, বাকৃবি, জাবি, জবির কোথাও ছাত্র সংসদের নির্বাচন নেই। সিনেটের নির্বাচন নেই। সরকার পছন্দমতো ভিসি নিয়োগ দিচ্ছে। ওই ভিসিরাই সেখানে সরকারপ্রধানের বরকন্দাজের মতো কাজ করছেন।
ছাত্রসমাজকে এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে।