বানের জলে ভেসে আসা আন্তর্জাতিক হাতিটি(!), হাতি দিবসে হুঁশ ফিরে পেলেও আমরা মানুষের কল্যানকামীতার প্রশ্নে যে বেঁহুশে আছি, তার জ্বলন্ত প্রমাণ সদ্য ভারত থেকে পাহাড়ি ঢলে বাংলাদেশের সীমায় ভেসে আসা বুনো হাতিটি এবং দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বানভাসি মানুষের চির দূর্ভোগের চিত্র । হাতিটিকে নিয়ে কত দহরম-মহরম হয়ে গেলো এবং যাচ্ছে অথচ দেশের কয়েক কোটি মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে অখাদ্য-কুখাদ্য ভক্ষণ করে নানা রোগে-শোকে জর্জরিত হয়ে কোনভাবে প্রাণে বেঁচে আছে-তাদের কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে সন্তোষজনক কোন পরিকল্পনা পর্যন্ত নাই । পেয়ে বসেছি একটি হাতি, হাতি যেন জীবনে দেখিনি-এমন কান্ডকারখানা চলছে আমাদের ভরসার সবটা জুড়ে ! অবস্থা দেখে মনে হয়, বন্যা তো প্রতি বছর আসে কিন্তু বানের জলে ভেসে হাতি কি আর বারবার আসবে-তাই সঙের সবটুকুই তো প্রকাশ করা চাই ।
…..
দুর্ভাগ্য আমাদের কেননা যারা মানুষের বাহ্য বিবেক হিসেবে ভূমিকা পালনের দায়িত্ব নিয়েছে তাদের বিবেক আজ কাঠগড়ায় । বিবিসি বাংলার মত একটি জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমে বুনো হাতিটি কযেকটি প্রতিবেদন ২২ বার প্রচারিত হয়েছে অথচ উত্তরাঞ্চলের মানুষের দুর্দশা নিয়ে, বন্যার কারণ-প্রতিকার ও সাহায্যের ব্যাপারে তাদের উল্লেখ করার মত অবস্থান নাই । দেশের যে সকল গণমাধ্যম (প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক্স-অনলাইন পোর্টাল) রয়েছে তারা হাতিটি নিয়ে যেভাবে সংবাদ প্রকাশ করেছে ঠিক এতটুকু সংবাদ প্রকাশ করে যদি সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতো, তবে বাংলাদেশী কোন মানুষকে বিএসএফের গুলিতে সীমান্তে জীবন দিতে হতো না ।
…..
উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে কিন্তু নিরাপদ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব এবং নানা রোগের প্রকোপে তারা আজ দিশেহারা । তাদের যে পরিমান সহায়তা দরকার তা সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগ দ্বারা যোগান ও বন্টনের সুববস্থ্যা হয়নি । আমাদের রাষ্ট্র এতোটা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, যে কারনে কোনস্থানে দুর্যোগ দেখা দিলে তা তারা এককভাবে মোকাবেলা করতে পারে । কাজেই এক্ষেত্রে বেসরকারি সাহায্যই মূলত প্রধান ভূমিকা পালন করে । কোন অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ প্রকাশ এবং তাদের বেসরকারী সাহায্যে প্রাপ্তির ব্যবস্থার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য । গণমাধ্যম দূর্ঘটনার ভয়াবহতা, প্রাকৃতির রূঢ়তা এবং মানুষের দূর্ভোগ প্রকাশ করে মানুষের সহানুভূতি জাগ্রত করতে পারে । কিন্তু যাদের উদ্দেশ্য কেবল ইতর প্রানী নিয়ে ইতরামি করা, তারা সাধারণ মানুষের কথা বলবে কখন ?
…..
একটা হাতি যতটা প্রচার পেলো তার কিয়দাংশ প্রচার পায়নি বন্যা কবলিত মানুষের অসহায়ত্ব । সপ্তাহের পর সপ্তাহ মানুষ শুঁকনো চিড়া আর দুষিত পানি খেয়ে বেঁচেছে, ঘুমানোর মত আশ্রয় পায়নি, ভয়াবহ রকমের খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকট চলছে, পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর মুখ দেখে ফিরেছে, দেশের হাজার হাজার মানবেতর পশু-পাখি মারা গেছে-সেটার প্রকাশ আমাদের বিবেকে প্রধান্য দেয়নি বরং আমরা অনবরত বর্ণনা দিয়েছি একটি মাত্র বুঁনো হাতির কথা । বানিয়েছি ইতিহাস, কতরকম গল্প-সাহিত্য । সেটা কোথায় আছে, কি করছে, খাচ্ছে কিনা, সুঁড়ে কয়টা মোচড় দিলো-আরও কতকিছু !
…..
পশুপ্রেম নিশ্চয়ই উত্তম কাজ কিন্ত সে প্রেম যখন মানবপ্রেমের ওপর প্রধান্য পায় তখন সেটা আর ভালো থাকে না । যারা পশুকে প্রেম করতে গিয়ে মানুষের প্রেমের কথা, মানবতার জয়গানের কথা ভুলে যায় তারাও যে পশু তাতে আহামরি সন্দেহের অবকাশ থাকে বলে আমি মনে করিনা । তবুও আমাদের প্রেম আছে-সেটাও বা কম কিসে ? মানুষকে প্রেম দেখাতে পারলাম না তো কি হয়েছে, পশুকে প্রেম তো ঠিকই দেখিয়েছি । ইতিহাসের পাতায় আমাদের নাম উঠাতে এর চেয়ে মহৎ কর্মের কি আর দরকার পড়ে ? ইতারামিরও সীমা থাকা উচিত ।
…..
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।