বাংলাদেশ পরিচিত গার্মেন্টে দুর্দশাগ্রস্ত পরিবেশ ও ঘূর্ণিঝড়ের জন্য। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভঙ্গুর গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে উদয় হয়েছে বাংলাদেশের নাম। সঙ্গে বেড়েছে অর্থনৈতিক বিস্তার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশজ পলিটিক্যাল আনরেস্ট থ্রেটেনস ইকোনমিক গেইনস, ডেমক্রেসি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ সব কথা বলা হয়েছে। এটি লিখেছেন অ্যানি গোয়েন। দীর্ঘ ওই প্রতিবেদনে তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এর শিরোনামেই প্রতিবেদনের মূল ভাব প্রকাশ পেয়েছে। শিরোনামের বাংলা করলে দাঁড়ায়- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক অর্জন ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এতে তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকায় দেখা দিয়েছে নিঃশেষ হয়ে আসা এক ধরণের শীতলতা। এখানকার রাজপথে গার্মেন্ট কারখানার শিল্পপতিরা বিলাসবহুল গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন। গাড়িতে ঠাসা রাস্তায় পথ খুঁজে ফেরে রঙিন রিকশা। এ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (৬৬) ও তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া (৬৮)-এর মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে চার বার। তারা দু’জনে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছেন এমন ঘটনা বিরল। এ জন্য তাদের সংবাদ মাধ্যম ‘ব্যাটলিং বেগমস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সংক্ষিপ্ত সময়ের সেনাশাসন বাদে ১৯৯১ সাল থেকে এ দেশে রয়েছে নড়বড়ে গণতন্ত্র। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে সে বিষয়ে একমত হতে পারেননি এ দু’নেত্রী। খালেদা জিয়া তার সমর্থকদের হরতাল, মহাসড়ক অবরোধ করার ডাক দেন। তা সহিংসতায় রূপ নেয়। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতারা রাস্তায় লাঠি নিয়ে নামে। প্রতিবাদীদের হয়রান করে সরকারি বাহিনী। সন্দেহভাজনরা কমিউটার বাস ও অটোরিকশায় পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। খালেদা জিয়ার দল ওই নির্বাচন বর্জন করে, ভোট পড়ে কম। তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার ভূমিধস বিজয় হয়। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর চাপ দিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা ও অন্য কূটনীতিকরা। কিন্তু তা সফল হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভি স্বীকার করেন, নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে নতুন নির্বাচন হবে কিনা সে বিষয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। তিনি বলেন, এটা কি ৫ বছরের জন্য ম্যান্ডেট? আমি জানি না। ওদিকে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, কূটনীতিক ও বিএনপি নেতা শমসের মুবিন চৌধুরী বলেছেন, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের জেলে ঢোকাতে, সাংবাদিকদের ও মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানি করতে শেখ হাসিনা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হুমকিকে ব্যবহার করছেন। দু’দলের সহিংসতা আর নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কমপক্ষে ২০টি হত্যার সঙ্গে যুক্ত সরকারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকার কিছু এলিট শ্রেণীর লোক বলছেন, প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের জন্য তারা বিরক্ত। তবে শত্রু যদি হয় মৌলবাদী তাহলে তারা এটা সহ্য করে নিতে চান। প্রধান দলগুলো বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থাকে সমর্থন করলেও অনুষ্ঠিত নির্বাচন বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছে আরেকটি গভীর ফাটলে। এ ফাটল দেখা দিয়েছে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। এক গোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি অনুগত ও ধর্মনিরপেক্ষ, অন্য গোষ্ঠী চায় বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বানাতে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে রক্তাক্ত একটি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের সময় থেকেই এই বিভক্তি বিদ্যমান। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীর প্রায় এক ডজন নেতা ও বিএনপির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সিদ্ধান্ত নেন তখনই উত্তেজনা চড়তে থাকে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে একজনকে অভিযুক্ত করে প্রথমে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মে মাসে হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার সমর্থক ১৩ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ইসলামী ওই গ্রুপ ও নিরাপত্ত কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন কমপক্ষে ৫৮ জন। ইতিহাসের বেশি ভাগ সময় বাংলাদেশ আধুনিক ধারার ইসলামকে সমর্থন করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কট্টর ধর্মীয় গোঁড়ামি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় তা বেশি। ১৯৯৫ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে রাষ্ট্র অনুমোদিত মাদরাসা বেড়েছে শতকরা ৫৬ ভাগ। এ ছাড়া রয়েছে কয়েক হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ইলিনয়েস স্টেস ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক আলী রিয়াজ বলেন, এর মাধ্যমে পরিবর্তন হয়েছে দেশের সংস্কৃতি।