সিলেটের গোলাপগঞ্জের কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্রের পরিত্যক্ত কূপে আবারও গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ড। গ্যাস ক্ষেত্রটির ৭নং কূপ থেকে ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে শনিবার রাতে জাতীয় গ্রিডে আরও ১৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করল সিলেট গ্যাস ফিল্ড। কৈলাসটিলা গ্যাস ফিল্ডের সাতটি কূপের মধ্যে এতদিন দুটি কূপ থেকে দৈনিক ২ কোটি ৯০ লাখ ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতো। সবশেষ পরিত্যক্ত এ ৭নং কূপ থেকে আরও ১ কোটি ৯০ লাখ ঘনফুট গ্যাস দৈনিক জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলো যা নিয়ে কৈলাসটিলা গ্যাস ফিল্ডের ৪, ৬ ও ৭নং কূপ থেকে ৪ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাস দৈনিক জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। সুখবরটি শনিবার রাতেই সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে দিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

রোববার এ নিয়ে বিস্তারিত কথা হয় সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, এ কূপটি ওয়ার্কওভারের আগে তাদের প্রত্যাশা ছিল দৈনিক ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এখান থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু দৈনিক পাওয়া যাচ্ছে ১৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। তিনি জানান, এর সঙ্গে উপজাত হিসাবে মিলবে দৈনিক ২৫০ ব্যারেল কনডেনসেট যা থেকে ২২ লাখ টাকার জ্বালানি তেল পাওয়া যাবে। মিজানুর রহমান জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আরপিসের ধারণা মতে এই স্তরে মজুত রয়েছে ৭৫৮ বিলিয়ন ঘটফুট গ্যাস। প্রতি হাজার ঘটফুট গ্যাস ১০ ইউএস ডলারে হিসাব করলে যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা বলে তিনি জানান।

সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১০-১২ সালে বাপেক্সের কারিগরি সহায়তায় সিলেটের গোলাপগঞ্জের কৈলাশটিলা, জৈন্তাপুরের হরিপুর ও হবিগঞ্জের রশিদপুর গ্যাস ক্ষেত্রে নতুন করে ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক (থ্রিডি সাসমিক) জরিপ চালানো হয়। জরিপ চালিয়ে কৈলাশটিলা গ্যাস ক্ষেত্রের ৭ নম্বর কূপে তেল ও গ্যাস মজুতের সম্ভাব্যতা পায় বাপেক্স। জরিপে এ কূপের ১২টি স্তরে তেল ও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানায় বাপেক্স। এর মধ্যে চারটিতে তেল, একটিতে তেল-গ্যাস আর বাকি সাতটিতে গ্যাস মজুতের ধারণা করা হয়।

এমন সম্ভাবনা পাওয়ায় দেশের প্রথম তেল খনি হিসাবে ঘোষণা করে খোদ প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গোলাপগঞ্জ সফলকালে এ কূপটির খনন কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৪ সালের ১৭ অক্টোবরে শুরু হয় পুরোদমে খনন কাজ। ২০১৫ সালের ৮ মার্চ খনন কাজ শেষে একটি স্তরে গ্যাসের সন্ধান পেলেও তেলের সন্ধান পায়নি বাপেক্স। পরে ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন গ্যাস সরবরাহ শুরু হয় এ কূপ থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৬ সালের অক্টোবরে গ্যাস উত্তোলনের হার নেমে আসে ০.৫ মিলিয়ন ঘটফুটে। উত্তোলিত গ্যাস অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় ২ নভেম্বর এ কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০২১ সালের এপ্রিলে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে যোগ দেন মো. মিজানুর রহমান। তিনি ড্রিলিং লগ বিষয়ে পারদর্শী হওয়ায় যোগদান করেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া এ ৭নং কূপের তথ্য-উপাত্ত (লগ) নিয়ে কাজ শুরু করেন। লগ এনালাইসিস শেষে তিনি এ কূপের ৩০০০ মিটার গভীরতায় ৯ মিটার ব্যাপ্তি গ্যাস ও ২২৬৭ থেকে ২৩০০ মিটার গভীরতার স্তরে প্রায় ৩৩ মিটার ব্যাপ্তি গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সুফল পেতে তিনি নিচের স্তরটিতে অর্থাৎ ৩০০০ মিটার গভীরতাকে বেছে নেন। পরেই রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে এই কূপে ওয়ার্কওভারের জন্য ঠিকাদার হিসাবে নিয়োগ করে সিলেট গ্যাস ফিল্ড। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাপেক্সের বিজয়-১১ রিগ দ্বারা ওয়ার্ক ওভারের কাজ শুরু করে বাপেক্স।

২৪ ও ২৬ এপ্রিল ডিএসটির মাধ্যমে সফলভাবে ওয়ার্ক ওভারে কাজ শেষ হয়। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে শনিবার রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে ১৯ মিলিয়ন ঘটফুট গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। যদিও এই সুখবর ঈদের আগেই দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন ১০ মে পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে। এর ৩ দিন আগেই তা সম্ভব হয়েছে। শনিবার রাতে আবারও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার সুখবর দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালন মিজানুর রহমান জানান, মন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আমরা চেষ্টা করছিলাম ১০ মেতেই জাতীয় গ্রিডে দিতে। একটু শঙ্কাও ছিল সম্ভব হবে কিনা। কিন্তু সবার অক্লান্ত পরিশ্রমে ৩ দিন আগেই তা সম্ভব হয়েছে। যেহেতু দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে তাই আগে থেকেই পরীক্ষামূলকভাবে তা সরবরাহ করা হলো। এ সময় মিজানুর রহমান জানান, এই পরিত্যক্ত কূপ থেকে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। তিনি জানান, সিলেট গ্যাস ফিল্ডের অধীনে কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ডে ৭টি কূপ খনন করা হয়। এর মধ্যে ৪ ও ৬নং কূপ থেকে দৈনিক ২ কোটি ৯০ লাখ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ৭নং কূপের আরও ১ কোটি ৯০ লাখ ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হলো। তিনি বলেন, শুধু এ ৭নং কূপ নয় বন্ধ হয়ে যাওয়া বাকি চারটি কূপেও ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে নতুন করে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন অনুসন্ধানের পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। তিনি জানান শিগগিরই কৈলাশটিলার ২ ও ৩নং কূপের ওয়ার্ক ওভারের কাজও তারা শুরু করতে চান।