এখন সময় বিশ্লেষণ: উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য একটি নতুন যুগের উন্মোচন ঘটায় মুসলিম উম্মাহ অফ নর্থ আমেরিকার এবারের ‘মুনা কনভেনশন ২০২৩”।  এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন যেমন “ফোবানা”(ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা), ইসনা ( ইসলামিক সোসাইটি অফ নর্থ আমেরিকা), ইউনাইটেড আমেরিকান মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন (ইউএএমএ) বা অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনদের বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানিক কার্যক্রম প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেখে আসলেও এবারের ‘মুনা কনভেনশন ২০২৩” এর মতন এমন বৃহৎ আয়োজন এতটা চমৎকারভাবে এর আগে আর দেখা হয়নি প্রবাসী বাংলাদেশীদের।

মুসলিম উম্মাহ অফ নর্থ আমেরিকা সংক্ষেপে (মুনা) হচ্ছে আমেরিকার একটি দাওয়াতি ও সামাজিক সংগঠন।  মানুষের ব্যক্তিগত, নৈতিক ও সামাজিক মানোন্নয়নের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সামাজিক সংগঠনটি।  ১৯৯০ সালে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে করপোরেশনভুক্ত হওয়া সংগঠনটি বর্তমানে ৪০টিরও বেশি অঙ্গরাজ্যে নিয়মিত কার্যক্রম চালাচ্ছে।  সূচনা লগ্ন থেকে একটি দাওয়াতি সংগঠন হিসেবে মুনা মুসলিমদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলাম পালনের পাশাপাশি অমুসলিমদের কাছেও ইসলামের সঠিক শিক্ষা তুলে ধরার জন্য কার্যক্রম চালাচ্ছে।

নর্থ আমেরিকার মুসলিম কমিউনিটি সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের ঘরে ঘরে ইসলাম তথা পবিত্র মহাগ্রন্থ “আল কোরআনের” বাণী পৌছে দেয়ার অঙ্গীকারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়ার ঐতিহাসিক ‘পেনসিলভেনিয়া কনভেনশন’ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হলো মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকার (মুনা) ষষ্ঠ সম্মেলন।  করোনাকালীন বিরূপ পরিস্থিতির কারণে গত তিন বছর আমেরিকান-বাংলাদেশিদের অন্যতম বৃহৎ এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি।  দীর্ঘ বিরতির পর এবার নতুন রূপে এবং আরও বৃহৎ পরিসরে ‘মুনা কনভেনশন ২০২৩” এর আয়োজন করা হয়।  “আল-কুরআন-গাইডেন্স ফর হিউম্যানিটি” এ স্লোগান কে প্রতিপাদ্য করে এবারের কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।

শুক্র, শনি ও রোববার এই তিন দিনের সম্মেলনে উত্তর আমেরিকার প্রবাসী বাংলাদেশী সহ সারা বিশ্বের প্রায় ২০ হাজার ধর্মপ্রান মুসলমান অংশ নিয়েছেন বলে মুনা’র কর্তৃপক্ষরা জানিয়েছেন।  এবারের সম্মেলনে দেশ-বিদেশের ইসলামিক স্কলারদের পাশাপাশি মূল আলোচক ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবীদ, সুবক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারী।  সম্মেলনের কর্মকান্ডের মধ্যে ইসলামি চর্চা ও আলোচনা ছাড়াও ছিল সেমিনার, ছোটদের অনুষ্ঠান, মহিলাদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান, শিশু-কিশোর-কিশোরীদের খেলাধুলা, কালচারাল প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্রোগ্রাম প্রভৃতি। চারটি মহাদেশ থেকে ইসলামিক বিদ্বানরা উক্ত সম্মেলনে যোগ দেন।

হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন এবারের সম্মেলনটিকে একটি মহাসম্মেলনে রূপান্তরিত করেছে। এ আয়োজনের পেছনে ছিল একটি সুশৃঙ্খল দলগত প্রচেষ্টা। এ দলের প্রত্যেকটি সদস্যের যেমন সদিচ্ছা ছিল; তেমনি চিন্তা-চেতনায়ও তারা ছিল এক।  কোন বিষয় কেউ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি।  কেউ কাউকে টপকে যেতেও চায়নি। এ সম্মেলনে সৃজনশীলতার যে নমুনা তারা দেখিয়েছে তা উত্তর আমেরিকা প্রবাসীরা দীর্ঘ দিন মনে রাখবে।  অভ্যাগতদের স্বাগত জানিয়ে বিশাল তোরণ নির্মাণ হতে শুরু করে,সুশৃঙ্খল ভাবে রেজিস্ট্রেশন বুথের কর্মকাণ্ড, নান্দনিক ফটো গ্যালারিসহ সব কিছুই ছিল সুশৃঙ্খল এবং পরিপাটি।  অনুষ্ঠানের বিসালতা ছুয়ে গেছে আগত প্রত্যেক দর্শকের হৃদয়কে।  বিশাল নয়নাভিরাম মঞ্চের বিশালতা থেকে দর্শকদের বসার সারি পর্যন্ত প্রত্যেকটি কর্মকান্ডে ছিল নান্দনিকতার ছোঁয়া।  সবকিছু মিলিয়ে সম্মেলন সার্থক হলো তখন যখন হাজার হাজার দর্শক সুচারুরূপে উপভোগ করতে পেরেছেন সম্মেলনের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানমালা।  টিমওয়ার্কের আরেকটি নমুনা যা আপনার হৃদয় কে ছুয়ে যাবে, তা হলো এর তহবিল গঠনের পক্রিয়া। এ ধরনের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত করতে হলে  প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।  শুরুতে সংগঠনের সদস্যরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সম্মেলনের তহবিল তৈরি করেন।  এরপর শুভাকাঙ্খী, শুভানুধ্যায়ী এবং স্পন্সরদের কাছ থেকে অর্থ আসা শুরু হলো।  মিলিয়ন ডলারের এত বড় আয়োজন সুসম্পন্ন হয়েছে কেবল সুশৃঙ্খল একট টিমওয়ার্কের কারণে।  মুনা কর্তৃপক্ষের পরস্পরের মধ্যে সাম্প্রাদায়িক বিষবাষ্প ছিল না, রাজনীতি ছিল না, ছিল বুকভরা দেশপ্রেম।  স্বপ্ন ছিল একটি সফল আয়োজনের। তাদের সে স্বপ্ন পুরণ হয়েছে।

মুনা’র কনভেনশনে যোগদানকারী হাজার হাজার ধর্মপ্রান মুসলমানের একসাথে জুম্মার নামাজ আদায় ও কুরআন তেলোয়াতের মধ্যদিয়ে স্থানীয় সময় শুক্রবার (১৮ আগষ্ট) তিনদিনব্যাপী কনভেনশন শুরু হয়। উদ্বোধনী পর্বে প্রায় ৫ হাজারের মতো নারী পুরুষ অংশ নেন। সম্মেলনের আর্কষনীয় অনুষ্ঠানগুলো শনিবার দিনব্যাপী চলে। বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশ থেকে আগত ৫০ জনের মতো ইসলামী চিন্তাবীদ এ সম্মেলনের বিভিন্ন ইভেন্টের ওপর আলোচনা করেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের আলোচিত ও মালয়েশিয়ায় অস্থায়ীভাবে বসবাসকারি ইসলামিক স্কলার ড. মিজানুর রহমান আজাহারিও ছিলেন। আজাহারিকে একনজর দেখা ও তার বক্তব্য শোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ ফিলাডেলফিয়ায় সমবেত হন। মুনা নেতৃবন্দ জানান, গত সম্মেলনে ১৫ হাজারের মতো মুসলমান সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এবার যোগ দিয়েছেন সর্বস্তরের প্রায় ২০ হাজার মুসলিম নর-নারী। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে মুনা কনভেনশন হচ্ছে এককভাবে বাংলাদেশীদের সর্ববৃহৎ কোন সমাবেশ।  মুনা সম্মেলনকে ঘিরে পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়া শহর বাংলাদেশীদের সরব পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে। ফিলাডেলফিয়া শহরের ডাউনটাউন এলাকা মুসলিম কমিউনিটির উৎসবের শহর পরিণত হয়। উদ্বোধনী দিনে শুক্রবার সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন মুনা’র ন্যাশনাল কমিটির সভাপতি হারুন অর রশীদ, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, আব্দুস সালাম আজাদী, আহমেদ আবু ওবায়দুল্লাহ ও মাওলানা লুৎফর রহমান।

মুনা একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন নয়। মুনা চায় রাজনৈতিক বিষয়াবলীতে নাগরিকগণ সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করুক এবং এর ফলে রাষ্ট্রীয় জীবনে সুচারু সিস্টেম বহাল থাকুক। মুনা চায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দানকারী এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনশক্তি এবং অন্যান্য নাগরিকগণ বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে সক্রিয় যোগাযোগ রক্ষা করে চলুক যাতে করে তাদের কথা শোনা হবে এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা যাবে।  মুনা চায়, বাংলাদেশী-আমেরিকানরা কর্মতৎপরতায় বেশি বেশি করে সক্রিয় অংশগ্রহণ করুক। সাথে সাথে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে বাঁচাতে চায়। প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী অভিভাবক তাদের সন্তানকে মুনা ইয়ূথ এবং ইয়ং সিস্টার অফ মুনার সাথে সম্পৃক্ত করুক । মুনা চায় বাংলাদেশি আমেরিকানদের আমেরিকার মূলধারার মুসলিম স্কলার ও নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে।

শনিবারের সম্মেলন শেষে রাত সাড়ে ১১টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনের আহবান করেন মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকার (মুনা) কর্তৃপক্ষ। সংবাদ সম্মেলনের নবীন-প্রবীণ সাংবাদিকদের নানা বিষয় নিয়ে মতামত জানতে চান কর্তৃপক্ষ। অত্যন্ত সুশৃংখল একটি সম্মেলনের ভূয়সী প্রশংসা করেন সাংবাদিকগন, মুনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে এমন খোলামেলা আলোচনার সুযোগ পেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন উপস্থিত সাংবাদিকরা।  প্রবাসে বাংলাদেশীদের আম্ব্রেলা সম্মেলনের দাবী নিয়ে এতদিন যেসব সম্মেলন আয়োজনের প্রচেষ্টা হয়ে এসেছে সেখানে এবারের মুনা কনভেনশন ২০২৩ একটি আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।বলে সাংবাদিকগণ আশা ব্যক্ত করেন।