বাংলাদেশে লাগামহীন ঘোড়ার মতোই ছুটছে পেঁয়াজের দাম। কোনো কিছুতেই সেই দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না সরকার। আগের দিনের ১৭০ টাকার দেশি পেঁয়াজ বৃহস্পতিবার গিয়ে ঠেকল ২০০ টাকা কেজিতে। তবে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, দেশি পেঁয়াজের দাম ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি।
এদিন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজ ২০০ টাকা, মিশরীয় পেঁয়াজ ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা ও মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে।
আর সরকারি বিপণন সংস্থা টিবিসি বৃহস্পতিবারের পিঁয়াজের বাজার দর উল্লেখ করেছে, প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। এরমধ্যে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং দেশি পিঁয়াজ প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা।
কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে এসে তর্কে জড়িয়ে গেলেন হাবিবা নামের একজন ক্রেতা। ২০০ টাকা পেঁয়াজের দাম বলাতে তিনি খেপে গিয়ে বলেন, গত মঙ্গলবার ১৪০ টাকায় পেঁয়াজ কিনেছি। ২ দিনে ৬০ টাকা বাড়ার কারণটা কী?
জবাবে দাম আরো বাড়বে উল্লেখ করে পেঁয়াজ বিক্রেতা বললেন, আপনি শিক্ষিত মানুষ। পেঁয়াজের সরবরাহ না থাকলে, দাম বাড়বে না কমবে; তা চিন্তা করে দেখেন।
হঠাৎ করে দুইদিনেই ৬০ টাকা বেড়ে গেল কেন জানতে চাইলে পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রতা বাদশা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, যেখানে ৫ ট্রাক পেঁয়াজ আসার কথা, সেখানে আসে মাত্র ২ ট্রাক। ৩ ট্রাকের ঘাটতি থেকে যায়। সে কারণে দাম বাড়ছে।
তবে দাম বাড়া-কমার বিষয়টি বর্তমানে সম্পূর্ণ আমদানিকারকের উপর নির্ভর করছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
এই পাইকার বলেন, আমদানিকারকদের যদি দাম নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় তাহলে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা কমে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ-রসুন সমিতির প্রচার সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, শ্যামবাজারে ৭৮টি পেঁয়াজের আড়তের মধ্যে কেবল ৮টি আড়তে পেঁয়াজ রয়েছে। বাকিগুলোতে নেই।
‘‘সারাদেশের বাজারে প্রতিদিন কমপক্ষে চাহিদা ২শ’ ট্রাকের। কিন্তু আসে মাত্র ১০০ থেকে ১২৫ ট্রাক পেঁয়াজ। এতে ঘাটতি থাকে ৭০/৮০ ট্রাক পেঁয়াজ। প্রতি ট্রাকে সাধারণত ১৫ টন পেঁয়াজ আসে।’’
এই আড়তদার বলেন, ‘টিসিবি ইচ্ছা করলে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে। এতে দাম কমতো। এখন শুধু বেসরকারিভাবে আমদানিকারকরা পেঁয়াজ আমদানি করে। কিন্তু আমদানিতে তাদের অনেক ভোগান্তি সইতে হয়। তবু তারা আমদানি করছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমদানি হচ্ছে না। তাই সরবরাহে ঘাটতি থেকেই যা। এই ঘাটতি প্রতিদিনই বাড়ছ। এ কারণে দাম হু হু করে বাড়ছে।’
এই সমস্যা নিরসনে সরকারকেও পেঁয়াজ আমদানি করার পরামর্শ দিয়ে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আমার জন্মের পর হতে পেঁয়াজের দাম কখনও ২০০ টাকা শুনিনি। এটা রেকর্ড করলো। এই দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকেও পেঁয়াজ আমদানি করা দরকার।’
তার দাবি, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে ১৯ লাখ টন। এরমধ্যে পরিপক্ব হওয়ার আগেই তোলা হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টন। এতে মূল উৎপাদন টিকেছে ১৫ লাখ টন। তাহলে চাহিদা মেটাতে দরকার আরো ১৫ লাখ টন।
‘‘কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে যখন ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলো, সাথে সাথে আমরা সরকারকে বললাম, সরকারি ও বেসরকারিভাবে পেঁয়াজ আমদানি এখনই করতে হবে। নতুবা ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিবে। কিন্তু আমাদের কথায় গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বেসরকারিভাবে আমদানি করা হলেও এই পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’’
পেঁয়াজের এমন ঊর্ধ্বগতির পরও এর দাম এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।
তিনি বলেছেন, পেঁয়াজের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেই তার বিশ্বাস।
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশ মিশর, মিয়ানমার, তুরস্ক, পাকিস্তান, আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছে। কিন্তু তারপরও বাজারে পেঁয়াজের দাম কমেনি। বরং লাফিয়ে লাফিয়ে তা কেজিতে ২০০ টাকায় পৌঁছেছে।
পেঁয়াজের দাম বেশি রাখায় ৩ ব্যবসায়ীকে জরিমানা
মাত্রাতিরিক্ত দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা এবং পেঁয়াজের মূল্য তালিকা না টাঙানোয় রাজধানীর শ্যামবাজারের আড়তে তিন দোকানকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে আন্তঃমন্ত্রণালয় অভিযানিক দল।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর শ্যামবাজারের আড়তে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের এই জরিমানা করা হয়। শ্যামবাজারই রাজধানীতে পাইকারি পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় মার্কেট।
বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে গঠিক এই অভিযানিক দলটিতে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল। অভিযানে বিভিন্ন দোকানে পেঁয়াজের বিপুল মজুদ দেখা গেছে।
এ সময় মেসার্স বাণিজ্যালয়, নিট বাণিজ্যালয়, সিকদার অ্যান্ড সন্স ও রফিক ট্রেডার্স নামে ৪টি দোকানে অভিযান চালানো হয়। এর মধ্যে রফিক ট্রেডার্স পাইকারি ১২০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করলেও বাকি দোকানগুলো পেঁয়াজ বিক্রি করছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দরে। পরে রফিক ট্রেডার্স ছাড়া বাকি ৩ দোকানকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, পেঁয়াজ মজুদ করে বেশ কয়েকদিন ধরেই বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে— এমন অভিযোগের ভিত্তিতে আজকের অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানের শুরুতে নিট বাণিজ্যালয়ে পেঁয়াজের মজুদ পাওয়া গেছে। কিন্তু তারা এর কোনো চালান দেখাতে পারেনি। তারা ১৭০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। মেসার্স বাণিজ্যালয় পেঁয়াজ বিক্রি করছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। তারাও পেঁয়াজ কেনার চালান দেখাতে পারেনি। একই অভিযোগ রয়েছে সিকদার অ্যান্ড সন্সের বিরুদ্ধেও।
জব্বার মণ্ডল জানান, দোকানগুলোতে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য টাঙানো থাকলেও তাতে পেঁয়াজের দাম উল্লেখ নেই। এসব অসঙ্গতির কারণেই দোকানগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে।
পেঁয়াজের আড়ত ছাড়াও দই বোরহানির কন্টেইনারের গায়ে লেবেল না থাকা (উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ ইত্যাদি না লেখা) এবং বাসি গ্রিল বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করার অপরাধে মতিঝিল এলাকার কয়েকটি রেস্তোরাঁকে ১০ হাজার টাকা করে এবং বিসমিল্লাহ রেস্তোরাঁকে ৩০ হাজার টাকাসহ ৫ প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।